অনেক দেশেই বড় রাজনৈতিক দলের পতন বা দুর্বল হওয়ার পর নতুন বা অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোর উত্থান হয়েছে। এটি সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনপ্রিয়তা হ্রাস বা দলের অভ্যন্তরীণ বিভেদের কারণে ঘটে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসিবাদী দলের পতন হলে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর আবির্ভাব ঘটে। একইভাবে, ভারতে বিজেপির উত্থান কংগ্রেসের মতো পুরোনো দলের দুর্বলতার সুযোগে হয়েছে।
পুরোনো দলের প্রতি জনগণের অনাস্থা, নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক চাহিদা অথবা রাজনৈতিক আদর্শের পরিবর্তনের কারণে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর পিছিয়ে পড়ে। তবে, এই প্রক্রিয়া সব সময় একই রকম হয় না এবং বিভিন্ন দেশে এর ভিন্নতা দেখা যায়। একটি পুরোনো ও বড় রাজনৈতিক দলের পতন হলে, নতুন ও ছোট দলগুলোর উত্থান সাধারণত কয়েকটি উপায়ে হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে, পুরোনো দলের দুর্বলতা থেকে সুযোগ গ্রহণ, নতুন ইস্যু বা আদর্শের ভিত্তিতে সমর্থন তৈরি করা এবং জোটবদ্ধ হয়ে বা সমর্থন আদায় করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করা। কিছু দেশে দেখা যায় যে, বাম বা ডান ধারার পুরোনো দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মধ্যপন্থি বা নতুন আদর্শের দলগুলো ক্ষমতায় আসছে। আধুনিক বিশ্বে কিছু দেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো পুরোনো দলগুলোর জায়গা দখল করছে।

সাধারণত পুরোনো ও বড় দল দুর্বল হয়ে পড়লে তাদের সমর্থক ও কর্মীরা হতাশ হয়ে নতুন দলের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এই সুযোগে নতুন ছোট দলগুলো নিজেদের আদর্শ ও কর্মসূচি তুলে ধরে নতুন ভোটারদের আকৃষ্ট করেন। এছাড়া, পুরোনো দলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব বা নেতৃত্বের দুর্বলতা নতুন দলের জন্য সুযোগ তৈরি করে। নতুন দল পুরাতন দলের চেয়ে ভিন্ন বা নতুন কোনো ইস্যুতে জনমত তৈরি করতে চায়। যেমন, দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, পরিবেশ সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো নতুন দলের জনপ্রিয়তার কারণ হতে পারে। তাছাড়াও, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েও নতুন দলগুলো সমর্থন আদায় করতে পারে।
কখনো কখনো, নতুন ছোট দলগুলো পুরোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় বা তাদের সমর্থন আদায় করে। এমন পরিস্থিতিতে, পুরোনো দলের দুর্বলতা নতুন দলের জন্য নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সুযোগ তৈরি করে। এছাড়া, কিছু ছোট দল স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে এবং ধীরে ধীরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক পুরোনো দল দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, এবং জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থতার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং ভোটাররা নতুন বিকল্পের দিকে ঝুঁকে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক দেশে দেখা যায় যে, ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে তাদের সমর্থন হারাচ্ছে। বর্তমানে মাঠে থাকা দলগুলোর মধ্যে একই ধরনের স্বভাব যদি বিদ্যমান থাকে, তাহলে তাদেরও পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। যদি না তারা উন্নত যোগাযোগের আধুনিক যুগে দলের ভেতরে সংস্কার না করে। বড় দল হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় থাকা দলগুলো যদি পতন হওয়া দলের অপকর্ম ও বর্তমানে বিদ্যমান বড় কোনো দলের অপকর্মের প্রতিবাদ জারি না রাখে, তাহলে তাদের বড় হওয়ার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থাকবে। তাদের দলের আদর্শের সঙ্গে অন্য দলের আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণসহ সমাজের সব অন্যায়ের প্রতিবাদের মাধ্যমে জনগণের দলে পরিণত হওয়া সম্ভব। পুরোনো দলের যে দুর্বলতার কারণে তাদের পতন হয়েছে, সেই দুর্বলতা উত্তরণের মাধ্যমে নতুন ও ভিন্ন আদর্শের ছোট রাজনৈতিক দলের উত্থান সম্ভব।
পুরোনো দলের জনপ্রিয়তা নষ্টের বেশ কিছু কারণ থাকে :
- এক. দলের মধ্যে দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করলে, তা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে এবং দলের প্রতি সমর্থন হ্রাস করে।
- দুই. সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, দল তার মূল আদর্শ থেকে সরে গেলে বা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হলে, জনগণের সমর্থন হ্রাস পেতে পারে।
- তিন. পুরোনো দলগুলো নতুন পরিস্থিতি, নতুন প্রজন্মের চাহিদা বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থ হলে, প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে।
- চার. দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিভেদ ও ক্ষমতা দখলের চেষ্টা দলের ঐক্য নষ্ট করে এবং এর পতনকে ত্বরান্বিত করে।
- পাঁচ. নতুন প্রজন্ম তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রত্যাশা নিয়ে আসে। তারা পুরোনো দলগুলোর আদর্শ বা কার্যক্রমে সন্তুষ্ট না হয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বা পুরোনো দলের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করতে পারে।
- ছয়. সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শ এবং মানুষের পছন্দ পরিবর্তন হতে থাকে। পুরোনো দলগুলো যদি এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারে, তাহলে তারা তাদের সমর্থন হারাতে পারে এবং নতুন দলগুলো তাদের আদর্শের ভিত্তিতে জনগণের সমর্থন লাভ করতে পারে।
- সাত. ছোট দলগুলো প্রায়ই নতুন ধারণা, প্রতিশ্রুতি বা বিকল্প রাজনৈতিক পথের প্রস্তাব দিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যদি তারা কার্যকরভাবে জনগণের চাহিদা পূরণ করতে পারে, তাহলে তারা পুরোনো দলগুলোর স্থান দখল করতে পারে।
- আট. রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সমাজের গঠন বিভিন্ন হওয়ায়, এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সব দেশে একই রকম হয় না। কোথাও পুরোনো দলগুলো দ্রুত দুর্বল হয়ে যায়, আবার কোথাও তারা নিজেদের সংস্কার করে টিকে থাকে।
সুতরাং, নতুন বা ছোট রাজনৈতিক দলের উত্থানের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল এবং বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভরশীল। তবে এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক জগতে পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং পুরোনো দলের পতন এবং নতুন দলের উত্থান প্রায়শই দেখা যায়। ওপরের কারণগুলো ছাড়াও, আরো অনেক বিষয় রয়েছে, যা একটি পুরোনো দলের পতনে ভূমিকা রাখতে পারে। প্রতিটি দলের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)