অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমেরিকার ক্যামেরন পার্ক নামের শহরটির সবাই প্লেনের মালিক। এ শহরে অলিগলি কিংবা ছোটবড় রাস্তা বলে কিছুই নেই। মাত্র একটাই পথ, এর পুরোটাই রানওয়ে। শহরকে দুই ভাগে ভাগ করে সেই রানওয়ে এসে মিশেছে যে রাস্তায়, সেই রাস্তাটিও ১০০ ফুট প্রশস্ত। প্লেন অনায়াসে ওঠানামা করতে পারে সেখানেও। শুধু তা-ই নয়, ব্যস্ত রাস্তায় চলন্ত গাড়িকে পাশ কাটিয়ে এগিয়েও যেতে পারে কোনো রকম বাধা ছাড়া। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার এই ক্যামেরন পার্ক শহরে যারা থাকেন, তারা অফিস যান প্লেনে চড়ে। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতেও যান প্লেন নিয়ে। আমেরিকার সরকারি নথিতে অবশ্য ক্যামেরন পার্ক শহর নয়। আসলে একটি ফ্লাই ইন রেসিডেন্সিয়াল কমিউনিটি। কিন্তু এটি শহর নামে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার বহু বিমানবন্দর অচল হয়ে পড়েছিল। একই সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত বিমানচালকের সংখ্যাও বাড়ছিল। সংখ্যাটি ১৯৩৯ সালে ৩৪ হাজার থেকে বেড়ে ১৯৪৬ সালে ৪ লাখে গিয়ে পৌঁছায়। যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেই অবসরপ্রাপ্ত বিমানচালকদের আরামের অবসর দিতেই ফ্লাই ইন রেসিডেন্সিয়াল কমিউনিটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
না, বাংলাদেশে এমন বাস্তবতা নেই যে, শুধু বিমানের জন্য একটি শহর তৈরি হবে বা এমন একটি শহর যেখানে বাহন হিসেবে কেবল বিমান থাকবে! বাংলাদেশে কিন্তু বিমানযাত্রীর সংখ্যা নেহাত কম নয়। স্বাধীনতার পর অর্ধশতাব্দীকালে অনৈতিক পন্থায় দেশে বিপুল পরিমাণ কোটিপতির জন্ম হয়েছে। তাদের জন্য যেমন বিলাসবহুল গাড়ি-বাড়ি হয়েছে, তেমন দেশে-বিদেশে হরহামেশা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিমানব্যবস্থা। অবশ্য বিমান এখন কেবল ধনীদের বাহন নয়। বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি মানুষ বিদেশে কর্মরত। তারা বছরে কয়েক বার দেশে আসেন। তাদের একমাত্র বাহন বিমান। কিন্তু দেশের বিমানবন্দরগুলোতে সীমাহীন ঘুষ-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় তাদেরকে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রবাসী শ্রমিকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে টাকা উপার্জন করেন, সেই টাকায় দেশের অর্থনীতি সচল থাকে, কয়েক কোটি মানুষের মুখে অন্ন ওঠে। তারা যখন পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তানের জন্য কিছু পণ্য নিয়ে দেশে ফেরেন, তখন বিমানবন্দরে চরম অসহযোগিতা করা হয়, এমনকি ‘হারিয়ে যায়’ তাদের লাগেজ। এইসব অন্যায়-অসংগতি নিয়ে চলছে আমাদের বিমান পরিবহন।
আসা-যাওয়ার পথে বিমানযাত্রীদের টিকিট বুকিং থেকে শুরু করে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ পর্যন্ত সর্বত্রই হয়রানির শিকার হতে হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন কাস্টমস বাহিনীর হাতে। বিভিন্ন বিদেশি পণ্য, যেমন—সাবান, শ্যাম্পু, বাচ্চাদের জুতা বা খাদ্যপণ্যের প্রতি আগ্রহ আছে দেশের অসংখ্য মানুষের, এমন জিনিসের প্রত্যাশা বা আবদারও থাকে স্বজনদের। দেশে ফেরা প্রবাসীদের কাছে সাধারণ এসব পণ্য দেখলে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাস্টমস কর্মকর্তারা অর্থ আদায়ের জন্য হামলে পড়েন। আটকের পর এসব পণ্যের ওপর অনেক বেশি শুল্ক দিতে বলা হয়। যেখানে পণ্যের দামই অত হয় না। যাত্রী টাকা দিতে রাজি না হলে কর্মকর্তারা পণ্যগুলো জব্দ করে রেখে দেন। ভুক্তভোগী শুধু সাধারণ যাত্রী নন, আমদানিকারকরাও হন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী, এই ধরনের আইটেম বাজেয়াপ্ত করার কোনো আইনি ভিত্তি নেই। যেখানে অবৈধ আয়ের জন্য একধরনের অনানুষ্ঠানিক করের ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক কাস্টমস সদস্য মো. লুত্ফর রহমান বলেছেন, এ ধরনের চর্চা ব্যাপকভাবে চলছে, যেখানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রবাসী কর্মীরা।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় যেতে প্রবাসী কর্মীদের জন্য ভাড়ায় বিশেষ ছাড় প্রদান করেছে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিমানের বিপণন ও বিক্রয় পরিদপ্তর থেকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় যেতে প্রবাসী কর্মীদের জন্য ভাড়ায় বিশেষ ছাড় প্রদান করছে। ওয়ার্কার ফেয়ার বা শ্রমিকভাড়া নামের এই সুবিধা ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে চালু হয়েছে এবং আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত প্রযোজ্য থাকবে। এই ভাড়া শুধু নতুন কর্মী ভিসা এবং একক যাত্রা টিকিটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এতে আরো বলা হয়, ঢাকা থেকে সৌদি আরবের বিভিন্ন রুটে বর্তমানে মূল ভাড়া (কর বাদে) ৩৬০ মার্কিন ডলার, যা আগে ঢাকা-জেদ্দা রুটে ৪৮০, ঢাকা-রিয়াদ রুটে ৪০০, ঢাকা-মদিনা রুটে ৪৩০ এবং ঢাকা-দাম্মাম রুটে ৪০০ মার্কিন ডলার ছিল। এছাড়া, ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের বর্তমান ভাড়া ১৫০ মার্কিন ডলার, যা পূর্বে ছিল ১৭৫ মার্কিন ডলার।
আরো একটি সুখবর শুনিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। সড়ক ও রেলপথে চাপ কমিয়ে পর্যটন খাতসহ অর্থনীতি চাঙ্গা সচল করতে দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ২৮টি বিমানবন্দরের মধ্যে দ্রুত সচল হচ্ছে পরিত্যক্ত সাতটির কার্যক্রম। এসব বিমানবন্দর সংস্কারে ব্যয় নিরূপণসহ অন্যান্য বিষয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। প্রথমে চালু হবে বগুড়া বিমানবন্দর। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের পর অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ঈশ্বরদী, অর্থনীতির সম্ভাবনাময় ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, পর্যটন অঞ্চল মৌলভীবাজারের শমসেরনগর, ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ও রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দর সচল করার চেষ্টা চলছে। বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া জানিয়েছেন, অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি যেখানে আগে শেষ হবে, সেগুলো আগে সচল হবে। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বিমানবন্দরগুলো সচল হলে বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিচালনা করা যাবে।
সিভিল এভিয়েশনের সূত্রমতে, ২৮টি বিমানবন্দরের মধ্যে বর্তমানে রাজধানীর সঙ্গে আটটির বিমান চলাচল অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দর। বাণিজ্যিকভাবে সচল বাকি চারটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর রয়েছে রাজশাহী, যশোর, সৈয়দপুর ও বরিশালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার জন্য পরিত্যক্ত সাতটি বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিমান ওঠানামার জন্য দরকারি অবকাঠামো নেই। বেশ কয়েকটির রানওয়ে বেদখল হয়ে গেছে। কোনোটাতে গবাদি পশুর অবাধ বিচরণ, কোনোটিতে বাউন্ডারি ওয়াল ভেঙে পড়েছে। কোথাও আবার নেই নিরাপত্তা চৌকি। এসব বিমানবন্দর সচল করতে ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশে দ্রুত শিল্পায়ন, ব্যবসার প্রসারসহ পর্যটন খাতের বিকাশে পাকিস্তান আমলে সচল থাকা অথচ বর্তমানে পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলোর কার্যক্রম ফের শুরু হলে বদলে যেতে পারে পর্যটনসহ অর্থনীতির নানা খাত।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক