কাউকে তালগাছের বাগান করতে শুনিনি। দেশে শিমুলগাছেরও বাগান আছে, ফাগুন চৈত্রে দল বেঁধে মানুষ সুনামগঞ্জের সেই দুর্গম এলাকায় দেখতেও যায়। আম-কাঁঠাল-নারিকেল-সুপারির বাগান তো হয়-ই, কিন্তু সর্বৈব উপকারী তালগাছের কোনো বাগান নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের চোখ এড়িয়ে কায়ক্লেশে জীবনটাকে বাঁচিয়ে বড় হয়ে ওঠে তালগাছ। কারণটা বোধহয় এটাই যে, তালবীজের শরীর থেকে সব রস নিংড়ে নিয়ে ফেলে দেওয়ার সপ্তাহ পাঁচেক পরে বীজের ফোঁপড়াও মানুষের খাদ্যবস্তু হয়। আর এখনকার এই সর্বগ্রাসী সময়ে তাল তো পাকার অবকাশই পায় কম।
বৈশাখ জ্যৈষ্ঠের তীব্র খরতাপে তালের কচি শাঁস মানুষের প্রিয় খাদ্য। পাকা তাল প্রসেস করে পিঠা খেতে যে ঝক্কি, তাতে আর কেউ সহজে তালের পিঠার নাম তোলেন না। ঐতিহ্যের ফেরিওয়ালা কেউ কেউ তালের পিঠা খান বলেই কিছু তাল পাকার সুযোগ পায়। আর কিছু তাল পেকে যায় কপালের জোরে। তালগাছের কোনো অংশ মানুষের কাজে লাগে না!
এক কালে তালগাছের পাতাই ছিল লেখার বাহন। বইপুস্তক লেখা হতো তালপাতায়। এখন কাগজ তালপাতাকে সে দায় হতে মুক্তি দিয়েছে। তালপাতা ছিল হাতপাখা হওয়ার প্রধান হাতিয়ার। এখন ঘরে ঘরে ছাদ হতে ঝোলে বৈদ্যুতিক পাখা, ঘরে ঘরে এসি। ফলে তালপাতার কদর শেষ। তালপাতার ডগা থেকে তৈরি আঁশে হতো কাছি, তালের টুপি। এখন নাইলনের কাছি আরো শক্তপোক্ত, তাই তালের কাছিও বিদায়। মওলানা ভাসানী ছিলেন তালের টুপির ব্র্যান্ড এম্বেসেডর, তার মৃত্যুর পর চুকে গেছে সে পাটও। এখন কত রকম বাহারি টুপি! তালের রস হয়। তাড়ির বদনামের ভয়ে সেই রসকেও গোটাতে হয় পাত্তাড়ি।
তবে এখনো বৃষ্টি বাদল হয়, এখনো বিলে পানি জমে, আর সেই পানিতে চলাচল করতে লাগে ছোট নৌকা, ভেলা, বড় চাড়ি আর তালের ডোঙা। বিশিষ্ট লেখক ও সমাজ উন্নয়ন গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা আহাজারি করছেন, প্রতি বছর নড়াইল জেলার এক তুলারামপুর হাটেই ডোঙা বিক্রি হয় কমপক্ষে ৬ হাজার। নড়াইল ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের বিল অঞ্চলের মানুষ এই ডোঙা কেনেন। কিন্তু বছরে ৬ হাজার কেন ৬০০টিও তালগাছ লাগানো হয় কি না সন্দেহ।
তালগাছ না থাকলে ক্ষতি কী? তালের প্রায় সবকিছুর বিকল্প হয়ে গেছে। ডোঙার বিকল্পও আছে এবং হয়তো আরো হবে। তালগাছ কমে যাওয়ায় ভুগছে বাবুই পাখি, তার আশ্রয়ের প্রধান ঠাঁই-ই তো তালগাছ। আর ভুগছে মাঠে ঘাটে কাজ করা মানুষ, শিকার হচ্ছে বজ্রপাতের। ব্রিটিশ আমলে ভূমি জরিপের সময় মৌজার সীমানা চিহ্নিত করতে বিভিন্ন ধাতুমিশ্রিত পিলার বসানো হতো। কথিত আছে, এই পিলারগুলো ছিল বজ্রনিরোধক। প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে দেশের প্রায় সব সীমানাপিলার লোপাট হয়ে গেছে। ফলে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে ৩০০ মানুষ মারা যায়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাতের কারণে বছরে ২০ জনেরও কম মৃত্যু ঘটে। চলতি বছর (২০২৫) জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৭ জন বজ্রপাতে মারা গেছে। লাইটেনিং স্ট্রাইক লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইটে লিখেছে, বজ্রপাতের প্রথম উল্লেখ করেন পারস্যের রাজা জারজিকসের (রাজত্বকাল ৪৮৬-৪৬৫) পরামর্শক আরটেমিস। তিনি লিখেছিলেন, নগরের সবচেয়ে উঁচু দালান ও গাছে বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতের সময় বৃক্ষবিহীন খোলামাঠে কাজ করতে থাকা আমাদের কৃষকই তখন সবচেয়ে দীর্ঘ তাই মাঠে কাজ করতে থাকা মানুষটাই হয়ে পড়ে বজ্রপাতের শিকার। সম্প্রতি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ প্রাঙ্গণে বজ্রপাতকে বরণ করে নিয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে এক দীর্ঘ মেহগনি গাছ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই অবহেলিত তালগাছ মাঠে ঘাটে এক পায়ে দাঁড়িয়ে বজ্রপাতকে বরণ করে নিয়ে রক্ষা করেছে আমাদের।
আমরা বেশির ভাগ মানুষ অবহেলা করলেও কিছু লোক ব্যতিক্রমী বলেই তালগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কুষ্টিয়ার মিরপুরের কাকিলাদহ এক ব্যতিক্রমী গ্রাম। এ গ্রাম তালগাছের গ্রাম। এখানে আছে পনেরো-কুড়ি হাজার তালগাছ। গ্রামের তালগাছ হতে বত্সরে আয় প্রায় তিন চার কোটি টাকা। সিরাজগঞ্জের তাড়াশের মাধাইনগর ইউনিয়নের তত্কালীন চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান ১৯৭৫-৭৭ সালে তাড়াশ-নিমগাছি-ভুয়াগাতী ১৭ মিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে প্রায় ১৪ হাজার তালগাছ লাগিয়েছিলেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থাকতে ১৯৮৬ সালে নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কে ৫ হাজার তালগাছ লাগালে মনোমুগ্ধকর সে সড়ক এখন ঘুঘুডাঙ্গা তালতলি সড়ক নামে পরিচিতি পেয়েছে।
এই সড়কের তালগাছের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে একই জেলার মহাদেবপুরের নিরীহ গরিব গহের আলী তার জীবন ও সংসার চালাতে সারা দিন ভিক্ষার পাশাপাশি বাড়ি বাড়ি থেকে তালের আঁটি চেয়ে নিতেন আর রোপণ করতেন বিভিন্ন সড়কে। ২৪ বছর ধরে ভিক্ষার পাশাপাশি এটাই ছিল তার নিত্য দিনের কাজ। সারা জীবন তিনি প্রায় ১৮ হাজারেরও বেশি তালগাছ লাগিয়েছেন, পেয়েছেন ২০০৯ সালের পরিবেশ পুরস্কার। এম এম আল ফারুক ১৯৯০-৯২ সালে ঝিনাইদহ জেলার জেলা প্রশাসক থাকাকালে গাড়িতে করে তালের আঁটি আর কোদাল নিয়ে ঘুরতেন, যেখানেই অনুকূল পরিবেশ পেয়েছেন রোপণ করেছেন তালের আঁটি। এদের কীর্তিতেই বিভিন্ন সড়ক হয় দর্শনীয়, জনপদ থাকে বজ্রপাত থেকে নিরাপদ।
২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। বজ্রপাত ঠেকাতে একটি প্রকল্পের আওতায় ২০১৭ সালে দেশব্যাপী ১০ লাখ তালগাছের চারা ও ৩৫ লাখ আঁটি রোপণের একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ৩৮ লাখের মতো তালের আঁটি লাগিয়ে সে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়। যথাযথ পরিচর্যা না থাকায় চারাগুলো মারা যায়, নষ্ট হয়ে যায় আঁটিগুলোও। এ সময়ে প্রকল্পের পেছনে প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয় হয়। যার পুরোটাই গেছে গচ্চা। এ যেন সেই রাজার পুকুরে দুধ ঢালার মতো।
তাহলে তালগাছের সংখ্যা বাড়ানোর উপায় কী? সরকারি প্রকল্প নিলে আবারও যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেক্ষেত্রে তারুণ্যের উদ্যমতাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। স্কাউটিংয়ের মাধ্যমে বিস্তার ঘটতে পারে তালগাছের। দরকার সরকারের আনুকূল্য। সরকারের আনুকূল্য পেলে স্কাউটের সদস্যরা সড়ক, রেলপথ, পতিত জমি, জমির আইলে পরিকল্পিতভাবে তালগাছ রোপণ করতে পারে। আর এসব তালগাছ টিঁকিয়ে রাখার জন্য নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর ও তাড়াশের জ্ঞান ছড়িয়ে যাক সর্বত্র। পাঁচ বছরে প্রকৃত উদ্যোগ নিলে দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুঝুঁকি হ্রাস পাবে, গড়ে উঠবে পাখির আবাসন, নির্মল হবে পরিবেশ।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব