প্রতিটি সভ্য সমাজেই কিছু ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’ থাকে অর্থাৎ কী করা যাবে, আর কী একেবারেই করা যাবে না। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখন, যখন আমরা বুঝে উঠতে পারি না, কে কাকে বলছে, কেন বলছে, আর সেটি বাস্তব জীবনে আদৌ কেউ মেনে চলে কি না।
ধরা যাক, পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদের ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস তো আইন বইতেই লেখা আছে। যেমন : বিক্ষোভ হিংসাত্মক হলে তারা বলপ্রয়োগ করতে পারে (Do), কিন্তু তা করতে গিয়ে প্রকাশ্যে শিক্ষক বা ছাত্রকে লাথি মারা যাবে না (Don’t)।
কিন্তু সমস্যাটা হলো, পুলিশ যতই হ্যান্ডবুকে ‘ডু নট কিক দ্য প্রটেস্টার’ পড়ে পরীক্ষায় পাশ করুক না কেন, বাস্তবে যখন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছুঁয়েছে, অফিসার সাহেব তিন রাত ঘুমোননি, আর বিক্ষোভকারী তাকে সামনে দাঁড়িয়ে ‘গণবিরোধী লাঠিয়াল বাহিনী’ বলে গলা ফাটাচ্ছে, তখন হঠাত্ই তিনি ভুলে যান কোনটা ডু আর কোনটা ডোন্ট। তখন ‘লাঠি চালান’ নয়, বলা ভালো, ‘লাঠি চুলকান’ শুরু হয়। এক পুলিশ অফিসার একবার বলেছিলেন, ‘মৃদু লাঠিচার্জ বলে কিছু হয় না ভাই, লাঠি যখন চলে, তখন সেটা প্রেমপত্র নয়, আবেদনপত্রও নয়, ওটা হয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’
তাই কোনো অফিসার যদি কারা পেছনে একটি লাথি মারেন, সেটা হয়তো তার দৃষ্টিতে একটি হালকা উৎসাহব্যঞ্জক ধাক্কা। কিন্তু সেই ছবিটা যদি মিডিয়ার ক্যামেরায় ধরা পড়ে যায়, তাহলে আর রক্ষা নেই, গোটা জীবনের সত্পথে ছোটা কর্মজীবনের কফিনে শেষ পেরেক! পুলিশের রয়েছে বিরাট সমস্যা। উভয় সংকট। বিনা বাধায় ক্রুদ্ধ জনতাকে গন্তব্যে যেতে দিলে তারা তাণ্ডব চালায়। তখন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় পুলিশকেই। বাধা না দিলে তারাই কর্তব্যে অবহেলার দায়ে পড়ে। কিন্তু সেই নিক্তিতে তো আর সমাজ ঘটনা বা তার অভিঘাত মাপে না। বিশেষত সেই সমাজ, যা কাউকে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। যে সমাজ অন্যে কাদায় পড়লে খুশি হয়। অন্যের ব্যর্থতার নিরিখে নিজের সাফল্য নির্ধারণ করে। অতএব, এ একেবারেই আশ্চর্যের নয় যে, একজন মারমুখী পুলিশের ছবি যদি সাংবাদিকরা হাতে পান, তাহলে তা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে!
পুলিশ অভিযুক্তের কোমরে দড়ি পরাবে, জামার কলার বা ট্রাউজার্সের কোমরের কাছটা কষে ধরে প্রিজন ভ্যানে তুলবে, বেচাল দেখলে দু-চারটে চড়-থাপ্পড় মারবে বা একটু আবডাল রেখে কনুইয়ের গুঁতো। সেগুলোও করণীয়। ডুজ।
কিন্তু লাথি মারবে? গলা চেপে ধরবে? প্রচণ্ড গরমে গরম পানি ছিটাবে? প্রকাশ্যে? বিক্ষোভকারী কে? যার পেশাগত এবং সামাজিক পরিচয় ‘ছাত্র’ এবং ‘শিক্ষক’? নাহ্! সেটা কঠোরভাবে ডোন্টস-এর মধ্যে পড়ে। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, সেটা পরিত্যাজ্যের তালিকাভুক্ত।
পৃথিবীটা তো বড়ই নির্মম স্থান! ন্যায়-অন্যায়ের তুলাদণ্ড সেখানে কখনো সমান সমান থাকে না। সরকার বদলের কোপানলে পড়ে চাকরি হারানো শত শত মানুষ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, তারা কোন ন্যায়টা পেলেন? কেবল একটি বিশেষ রেজিমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে যোগ্য এবং অযোগ্যের ভেদরেখা যে গুলিয়ে গেল, সৎপথে খেটেখুটে চাকরিপ্রাপকদের সঙ্গে দলান্ধ ব্যক্তিরাও একাকার হয়ে গেল, কোনো তফাত রইল না, তা-ও কি ন্যায়? এটা কি হওয়া উচিত ছিল? মোটেই ছিল না।
এবার আসি আমাদের সমাজের অন্য স্তম্ভদের দিকে, ছাত্র-শিক্ষক জুটি। ছাত্রদের ডুজ অ্যান্ড ডোন্টসের তালিকায় লেখাপড়া করা, ক্লাসে যাওয়া, প্রশ্ন করা ইত্যাদি পড়ে। কিন্তু এখনকার ছাত্রদের ‘উন্নত সংস্করণ’ কিছু নতুন ফিচার নিয়েই আসে। প্রাক্তন এক শিক্ষক আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আগে পড়াশোনা না করলে ছাত্ররা ব্যাক বেঞ্চে বসত, এখন ব্যাক বেঞ্চ থেকে উঠে এসে সোজা শিক্ষককে মারধর করে!’
অন্যদিকে শিক্ষকদের ডোন্টসের তালিকায় লেখা থাকে, শিক্ষার্থীর গায়ে হাত তোলা যাবে না, মানসিক হেনস্তা করা যাবে না। অথচ, যখন ছাত্র হোয়াটসঅ্যাপে ‘স্যার ডেড’ লিখে দেয়, তখন সেই শিক্ষক সত্যি সত্যিই মানসিক মৃত্যু অনুভব করেন।
চিকিৎসকদের কথাও ধরা যাক। একজন ডাক্তারের ডুজ :রোগী দেখবেন, ব্যথা কমাবেন, হূদয়ে আশ্বাস দেবেন। ডোন্টস : রোগীকে অবহেলা করবেন না, চা খেতে খেতে বলতে পারবেন না, ‘এই রোগটা তো মানসিক সমস্যা না থাকলে হওয়ার কথা নয়!’
কিন্তু বাস্তবে কী হয়? ডাক্তার যদি সময় না দেন, রোগী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আবার সময় দিলেও রোগী বলেন, ‘ডাক্তার তো আমার সব বুঝে ফেললেন! ভূতে ধরেছিল কি না একবারও বললেন না!’ রোগীর আত্মীয়রা যেন হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকে নিজেরাই নীতিনির্ধারক হয়ে যান, আইসিইউর ভেতর ঢুকেই বলেন, ‘এই নার্সটা তো কোনো কাজের নয়!’ কিংবা ‘এরা তো রোগী মেরে ফেলে টাকা খায়!’ এখানে একটাই স্পষ্ট ডোন্টস থাকা উচিত ছিল, রোগী মারা গেলে দায় দেবেন না ছায়াকে। কিন্তু কে মানে?
বিচারকদের ডুজ অ্যান্ড ডোন্টসও রয়েছে। ডুজ : ন্যায়বিচার করবেন। ডোন্টস : পক্ষপাত করবেন না। একবার এক বিচারক বলেছিলেন, ‘আপনারা তো ফেসবুকে সব লিখে দেন, কোর্টে এসে আর কিছু বলার থাকে না!’ এবার বলুন, বিচারক বা আইনজীবী যদি নিজের বিচারে ফেসবুকের পোস্ট ব্যবহার করেন, তাহলে কি সেটি ডুজ না ডোন্টস?
পাবলিকের ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস আরো বিভ্রান্তিকর। করণীয় : করের টাকা দেবেন, নিয়ম মেনে চলবেন, রাস্তায় প্লাস্টিক ফেলবেন না। বর্জনীয় : গুজব ছড়াবেন না, ভাঙচুর করবেন না, চিকিৎসকদের মারবেন না, পুলিশকে পুড়িয়ে দেবেন না।
কিন্তু পাবলিক তো পাবলিকই। তারা নিজেদের জন্য ‘কর্তব্য’ শব্দটি সংরক্ষণ করে না। তারা শুধু ‘অধিকার’ শব্দটা মুখস্থ রাখে। কেউ যদি বলে, ‘আপনার এই কাজটা ভুল, সে সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলে, ‘আমার ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে!’
ডুজ : সৎভাবে রাজনীতি করবেন, ডোন্টস : দুর্নীতিতে জড়াবেন না। কিন্তু এই নীতিগুলো পড়ে মনে হয়, যেন বাংলা সিনেমার পুরোনো সংলাপ। এখনকার রাজনীতিকরা এই নিয়মকে একটা সাজেশন বক্স বলে মনে করেন, চাইলে মানবেন, না চাইলে হেসে উড়িয়ে দেবেন।
একবার এক নেতা নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ‘আমরা স্বচ্ছতা আনব।’ পরে দেখা গেল, স্বচ্ছতার সংজ্ঞা ছিল, দলীয় কর্মীদের চোখে যতটা স্বচ্ছ মনে হয়!
আর সংবাদমাধ্যম? এদের ডুজ : সত্য খবর পরিবেশন করা। ডোন্টস : গুজব ছড়ানো, বিচারপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ। কিন্তু বাস্তবে কী হয়? কোনো পুলিশ অফিসার লাথি মারলে সেটা ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেকিং নিউজ’ হয়। কেউ সাহায্য করলে সেটা হয় ‘বিরল ঘটনা’।
অন্যের ব্যক্তিগত মুহূর্তকে জনসম্মুখে এনে তার ওপর টিআরপির রোলার চালিয়ে যাওয়া যেন মিডিয়ার নিজস্ব ডু। ডোন্টস কী? সম্ভবত, সেটার সংজ্ঞা এখনো আপলোড হয়নি।
সব মিলিয়ে, আমাদের দেশেই একখানা ‘সার্বজনীন আচরণবিধি নীতিমালা’ থাকা দরকার। পেশাভেদে না হয় সরকার একটা বই ছেপে দিল : ছাত্রদের ডুজ : পড়াশোনা, প্রশ্ন করা, প্রতিবাদ করা। ডোন্টস : শিক্ষকের গায়ে হাত দেওয়া, ক্লাসে খেলা। পুলিশের ডুজ : আইনরক্ষা, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ডোন্টস : খেপে গিয়ে সপাটে লাথি মারা (ক্যামেরা অন থাকলে বিশেষত না)। ডাক্তারের ডুজ : নির্ভুল চিকিৎসা, সহানুভূতিশীল ব্যবহার। ডোন্টস : রোগীকে হয়রানি না করা। সংবাদমাধ্যমের ডুজ : তথ্যভিত্তিক রিপোর্টিং। ডোন্টস : নিউজকে ‘রিয়েলিটি শো’ বানানো। রাজনীতিকের ডুজ : দেশসেবা। ডোন্টস : প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলে যাওয়া এবং স্মৃতি হারানোর অভিনয়। পাবলিকের ডুজ : ন্যায়ের পাশে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা। ডোন্টস : নিজের ভুল ঢাকতে সবাইকে টেনে নামানো।
সবশেষে, এই সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডুজ হতে পারে : নিজের কাজটা ঠিকঠাক করা। আর সবচেয়ে জরুরি ডোন্টস : অন্যের ব্যর্থতা দেখে উৎসব না করা।
তাতে সমাজ হয়তো বদলাবে না, কিন্তু অন্তত আমরা জানব, আমরা কোন তালিকার মধ্যে পড়ি। তাহলে হয়তো একদিন, মাথায় বোতল নিক্ষেপের বদলে যুক্তি চলবে, ঠেলাঠেলির বদলে কথাবার্তা, আর করণীয়-বর্জনীয়র তালিকা মুখস্থ না করেও মানুষ মানুষ থাকবে।
লেখক : রম্যরচয়িতা