পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গের মুখে বহুল উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে থাকবে ‘ঐতিহাসিক’ এবং ‘যুগান্তকারী’—এ দুইটি শব্দ। তবে এ জাতীয় শব্দগুলো যে সব ক্ষেত্রে জ্ঞানীগুণী বা বিজ্ঞজনরাই ব্যবহার করেন, তেমন নয়। বরং কখনোসখনো শব্দগুলো ভুল মানুষের মুখ থেকে ‘ভয়ানক ভুলভাবে’ ব্যবহূত হতেও দেখা যায়। জুতসই উদাহরণ হিসেবে বলতে হয় ২০০৯ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কায়রো ভাষণের কথা। খুঁজলে এরকম আরো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে।
তবে, এ কথায় সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১৩ মে ‘রিয়াদ ভাষণ’ বিশ্বরাজনীতিতে ‘গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস’ হয়ে থাকবে। ইতিহাসের পাতায় ‘একটি বাঁক’ হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে রইবে। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং ‘রিয়াদ স্পিস’ অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ এ কারণে যে, চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের এ সফর কেবল সৌদি-মার্কিন সম্পর্কের জন্যই নয়, বরং গোটা অঞ্চলটির জন্যই বিশেষ বার্তা বহন করে।
মূলত, ট্রাম্পের রিয়াদ ভাষণ এতটাই ‘শক্তি বয়ে এনেছিল’ যে, প্রায় বলা যায়, তিনি রীতিমতো রকস্টারের মতো অভ্যর্থনা পান। তার প্রতিটি কথা গভীরভাবে অনুরণিত হয়, যা মার্কিন-আরব সম্পর্কে ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
ভাষণটিকে ঐতিহাসিক করে তোলার পেছনে তিনটি প্রধান বিষয় কাজ করেছে; এগুলো হলো—ট্রাম্পের রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রস্তাব, আমেরিকার অতীতের ভুলগুলোর ব্যাপারে খোলামেলা কথাবার্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে কর্মপরিকল্পনা বা রূপরেখা প্রণয়ন।
যাহোক, ট্রাম্পের রিয়াদ স্পিসের তিনটি দিক খুবই উল্লেখযোগ্য।
প্রথমত, ইরানের প্রতি ট্রাম্প শান্তির বার্তা দিয়েছেন, যা এতদঞ্চলের রাজনৈতিক গতিশীলতায় একটি সম্ভাব্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে। তিনি দামেস্কের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে সিরিয়াসংকট সমাধানের সুসংবাদ শুনিয়েছেন। সব থেকে বড় যে কাজটি করেছেন, ফিলিস্তিনিদের অবস্থার উন্নতির প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টের মুখে।
শুধু তা-ই নয়, লেবানন পুনর্গঠনে মার্কিন সমর্থন ও সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছেন ট্রাম্প। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় এ উদ্যোগ ব্যাপক কাজে আসবে। পাশাপাশি বলতে হয় ইউক্রেন যুদ্ধের কথা—রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতা করার জন্য সৌদি আরবের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প খুব খোলামেলাভাবে আগেকার মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির ভুল পদক্ষেপের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো নব্য রক্ষণশীল এবং বারাক ওবামার মতো উদারপন্থি নেতাদের পর্যন্ত সমালোচনা করতে ছাড়েননি। উভয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপবাদী কৌশলের সমালোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন, গৃহীত সেসব পদক্ষেপ অতীতে এ অঞ্চলকে কীভাবে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।
ভাষণে বুশের ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। সৌদি আরব জোরালোভাবে সতর্ক করার পরও এহেন বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণের পথে হেঁটেছিল বুশ প্রশাসন। একইভাবে, ওবামার ‘অযোগ্য উপদেষ্টা’ বেন রোডস এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন আবেগের খেসারত হিসেবে তথাকথিত আরব বসন্তের বিপর্যয়কর ফলাফলের কথা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
ইরাকে মার্কিন আক্রমণের প্রস্তুতিপর্বের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। ঐ সময় সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স সৌদ আল-ফয়সাল এ নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘তাদের (ইরাকি সেনা ও কর্মকর্তারা) কী হবে, বিশেষ করে যদি সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া হয় এবং সরকার তাদের বরখাস্ত করে?’ তিনি আরো প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আপনি যদি ইরাক শাসন করার কথা চিন্তা করেন, সেক্ষেত্রে শাসনক্ষমতায় কাকে বসাবেন?’ এমনকি তিনি এ-ও জিগ্যেস করেছিলেন যে, ‘সাদ্দাম হোসেনের অধীনে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষের সুবিশাল বাহিনী ইরাক নিয়ন্ত্রণ করত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বড়জোর দেড় লাখ লোক আছে এ মিশনে। সুতরাং, স্বভাবতই প্রশ্ন হলো, আপনি কীভাবে কাজটি শেষ করবেন।’
তত্কালীন সময়ে সাদ্দাম হোসেনের শাসনব্যবস্থা খারাপ ছিল কি ছিল না, তা বিবেচ্য ছিল না, বরং এ অঞ্চল ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা সঠিক ছিল কি ছিল না, সেটাই বিচার্য ছিল আমেরিকার জন্য। অথচ পরে দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক আক্রমণ করে বসলে এটা অন্যতম বিতর্কিত বৈশ্বিক ইস্যুতে পরিণত হয়।
ট্রাম্প বলেছেন, তথাকথিত ‘জাতি-নির্মাতারা’ জাতি গড়ে তোলার কাজে যতটা না সফল হয়েছিল, তার চেয়ে বরং অনেক বেশি ধ্বংস করেছিল! ‘হস্তক্ষেপবাদীরা’ এমন সব জটিল সমাজে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে যে, এর ফলাফল সম্পর্কে সম্ভবত তাদের নিজেদেরও ধারণা ছিল না! তারা এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের ছবক দিয়েছিল বটে, কিন্তু তারা নিজেরাই এ বিষয়ে অন্ধকারে ছিল।
বক্তৃতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কখনোই নিজের ঐতিহ্যের আমূল প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্যকে আলিঙ্গন করার মধ্য দিয়েই এগুলো অর্জিত হতে পারে।’ এরকম বার্তার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যের প্রগতিশীল দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করার অভিপ্রায়ের কথাই ব্যক্ত করেছেন।
ট্রাম্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ‘আমাদের চোখের সামনেই নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব অতীতের বিতর্কিত সংঘাত-সংঘর্ষ এবং জঘন্য বিভাজনের রেখা অতিক্রম করে চলেছে। সামনের দিনে তাদের হাত ধরে এমন একটি ভবিষ্যত্ তৈরি হবে, যেখানে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে উঠবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। বিশৃঙ্খলা নয়, বরং এই অঞ্চল সংজ্ঞায়িত হবে অর্থনীতির দ্বারা। এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রযুক্তি রপ্তানি করবে, সন্ত্রাসবাদ নয়।’
তৃতীয়ত, ট্রাম্প উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের অর্জনগুলোর প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের অবদানের কথা স্বীকার করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এসব রাষ্ট্রের চলমান রূপান্তরের প্রতি মার্কিন সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। বিশেষ করে, ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনা’ উন্মোচনের পর থেকে গত নয় বছরে সৌদি কিংডম যে অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে; সৌদি অর্থনীতি ও সমাজে ব্যাপক বিপ্লব ঘটছে, তার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘একটি আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যের জন্ম হয়েছে এবং তা হয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের দ্বারাই। সেই মানুষগুলো এখানেই আছে। তারা সারা জীবন এখানেই বসবাস করেছে; নিজস্ব সার্বভৌম দেশ গড়ে তুলেছে; নিজস্ব অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করছে এবং নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করছে।’ ট্রাম্প উল্লেখ করেন, ‘এসব সত্যিই অবিশ্বাস্য।’
সৌদি আরবের প্রতিরক্ষায় ৮০ বছরের মার্কিন প্রতিশ্রুতি নবায়ন করেছেন ট্রাম্প। তিনি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করেছেন যে, দুই দেশের সম্পর্ক নিরাপত্তার বাইরেও বহু ক্ষেত্রে বিস্তৃত থাকবে এবং কিংডমের সেই নেতৃত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় বিশ্বাসী ও পূর্ণ সমর্থন থাকবে।
ট্রাম্প বলেছেন, ‘বাদশাহ সালমান এবং ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদের নেতৃত্বে সৌদি আরবে যে রূপান্তর ঘটেছে, যে উন্নতি হয়েছে, তা সত্যিই অসাধারণ।’ তিনি যোগ করেন, ‘আগে কখনোই এতটা বৃহত্ পরিসরে এমন কিছু ঘটতে দেখিনি।’ ক্রাউন প্রিন্স সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘আমি সত্যিই বিশ্বাস করি, আমরা একে অন্যকে খুব পছন্দ করি।’ ক্রাউন প্রিন্সকে নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ কথা বলতে বাদ রাখেননি যে, ‘আপনি আরবীয় উপায়ে এমন সব আধুনিক অলৌকিক কাজ করেছেন, যা সত্যিই অসাধারণ।’ বলা বাহুল্য, ট্রাম্পের এ মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং তার ‘রিয়াদ স্পিস’ যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব সম্পর্ক তো বটেই, বিশ্বরাজনীতির জন্য এক নতুন সমীকরণ সামনে নিয়ে আসবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
লেখক : আরব নিউজের প্রধান সম্পাদক
আরব নিউজ থেকে অনুবাদ : সুমৃৎ খান