ট্রাম্প প্রস্তাবিত নতুন গাজানীতি অনুসারে হামাসকে ইসরাইলের জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর হোয়াইট হাউজে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানয়াহুর সঙ্গে আলোচনার পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প এই নীতির ব্যাখ্যা দেন। তার দাবি, নতুন এই পরিকল্পনায় আরব এবং ইসলামি দেশগুলো, এমনকি হামাসেরও সম্মতি রয়েছে। যদি এমনটাই হয়, তাহলে হামাস আর গাজার কোনো বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে থাকবে না, এমনকি এই নামের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব থাকবে না। এরপর থেকে গাজা পরিচালিত হবে ‘বোর্ড অব পিস’ নামক একটি কর্তৃত্বের অধীনে, যার প্রধান থাকবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করবেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। ধারণা করা হচ্ছে তাকেই গাজার অন্তর্বর্তী শাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যকার আলোচনার সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি সবার দৃষ্টি কেড়েছে, তা হলো— এতদিন ধরে গাজায় ইসরাইল কর্তৃক পরিচালিত হামাসবিরোধী অভিযানে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সায় ছিল, তা এককথায় ট্রাম্প যেন তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার করে দিলেন। নেতানিয়াহুর মতো তিনিও গাজায় হামাস নামে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব থাকবে না— এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিলেন। হামাসকে আত্মসমর্পণের শর্তে সাধারণ ক্ষমার বিষয়টি উল্লেখ করার পাশাপাশি তিনি নেতানিয়াহুর মতোই ফিলিস্তিন জনগণের অধিকারের বিপরীতে নিজের অবস্থান নিয়েছেন, যার প্রকাশ ঘটেছে তার এই বক্তবে যে, ‘গাজায় ফিলিস্তিনের কোনো শাসন থাকবে না’, বরং তার ভাষায় ফিলিস্তিন এরপর থেকে পরিচালিত হবে একটি ‘বোর্ড অব পিস’-এর মাধ্যমে। ইসরাইলের পক্ষে তিনি এই বলেও মন্তব্য করেছেন যে, যদি হামাস এসব শর্ত পালন না করে, তাহলে ইসরাইলের তরফ থেকে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন থাকবে।

আরব ও ইসলামি দেশগুলোর ট্রাম্পের এই প্রস্তাবের পক্ষে সায় রয়েছে বলে দাবির পর এখন এটাই ধরে নেওয়া যায় যে, হয় হামাস অস্ত্র সমর্পণ করে ইসরাইলের অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেবে, নয়তো ইসরাইলের পক্ষ থেকে আরো কঠোর হামলা মোকাবিলা করতে হবে। দুই নেতার এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে কার্যত ইসরাইল যেভাবে সাম্প্রতিক সময়ে আগ্রাসী আচরণ করে যাচ্ছে, এর পক্ষ্যে সমর্থন মিলেছে এবং এবার নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পর গাজার ধ্বংসলীলার কফিনে তিনি শেষ পেরেকটুকু ঠুকবেন।
নেতানিয়াহু যে কতটা বিধ্বংসী হতে পারেন, এবং তার এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সপক্ষ্যে নির্লজ্জভাবে সাফাই করতে পারেন, এর সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ মেলেছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তার বক্তব্যের মাধ্যমে। তার বক্তব্যের সময়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশের প্রতিনিধি সভাস্থল থেকে ওয়াকআউট করলেও তিনি এতদিন ধরে গাজায় যা করে গেছেন, এর প্রতি নিজের যুক্তি তুলে ধরে ভবিষ্যতেও এহেন কর্ম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তার সংকল্প ব্যক্ত করেন। তিনি অনেকটাই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করেন যে, অনেক দেশ প্রকাশ্যে ইসরাইলের এসব কর্মকাণ্ডকে সমালোচনা করলেও গোপনে ইসরাইলের প্রশংসা করেন। তবে এটা তিনি কতটা যথার্থভাবে বলেছেন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। বিশেষ করে এবারের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ ১০টির অধিক দেশের পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর নেতানিয়াহুর তরফ থেকে এই দাবি খুব যৌক্তিকভাবে টেকে না যে, তিনি এখনো পশ্চিমা দেশের পক্ষ থেকে আগের মতোই সহানুভূতি পাচ্ছেন।
মূল আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে গাজা নিয়ে নতুন শান্তি পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে গাজায় হামাসের অপমৃত্য ঘটলে এবং এর মধ্য দিয়ে গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন করে ফিলিস্তিন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং এটা সন্দেহাতীতভাবেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে, এমন দৃষ্টিভঙ্গিকেই ধারণ করবে। এখানেই কিছু সংগত প্রশ্ন সামনে চলে আসে, প্রথমত; ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তি চুক্তির অবসান ঘটবে এর মধ্য দিয়ে, যেখানে পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি স্বীকৃত ছিল। সেই সঙ্গে একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যকার স্বাক্ষরিত ডেটন চুক্তির কার্যকারিতাও বিলুপ্ত হবে, যেখানে উভয়েই একে অন্যকে স্বীকৃতি দিয়ে পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল। এতদিন ধরে যেখানে বিশ্বব্যাপী এটাই স্বীকৃত সত্য ছিল যে, ফিলিস্তিন সংকটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে দ্বিরাষ্ট্রিক ব্যবস্থা, এর মধ্য দিয়ে আবারও ১৯৪৮, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ সালের দিকে, অর্থাত্ পেছন দিকে হাঁটা হচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছে। বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশের বেশি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি সত্ত্বেও এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে কেবল যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অপরাপর দেশের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে, ফিলিস্তিন জনগণের দীর্ঘ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় একমাত্র বাধাদানকারী দেশটির নাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
আজ গাজাকে যেভাবে একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত করা হয়েছে, এটা এককথায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। হামাস যদি একটি সন্ত্রাসী সংগঠনই হয়ে থাকে, তবে সেটি প্রতিরোধের দায়িত্ব গাজাবাসীর এবং ফিলিস্তিনের জনগণের। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, হামাস ২০০৭ সালে গাজায় সাধারণ জনগণের ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে। বর্তমানে বিশ্বে এটাও ব্যাপকভাবে চাউর আছে যে, এই হামাস বা সারা বিশ্বে যত উগ্রপন্থি সংগঠনের বিকাশ এবং বিস্তার ঘটেছে, এর পেছনে একধরনের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব কাজ করে, অর্থাত্, এসবের নেপথ্যে ইসরাইল তথা পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাপকভাবে ভূমিকা রাখে। আমরা যদি এক ফিলিস্তিনের ভেতর পশ্চিম তীর এবং গাজার মধ্যে শাসনতান্ত্রিক বিভেদের দিকে নজর দিই, তাহলেই এর জবাব পেয়ে যাব। একসময় ফিলিস্তিনের জনগণ তাদের নিজেদের জাতীয়তাবাদের বিষয়ে একটি জাতিসত্তায় বিশ্বাসী হলেও পশ্চিমা ষড়যন্ত্র তাদের মধ্যে এই বিভক্তি এনে দিয়েছে, যার খেসারত দিতে হচ্ছে গাজাকে। এখানে এটাও ভাবার কোনো কারণ নেই যে, গাজা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর এই সমস্যা মিটে যাবে। এখানে আমাদের একটু সযত্ন মনোযোগ দিতে হবে নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোর দিকে। তিনি বেশ সরবেই আজকাল উচ্চারণ করছেন যে, ফিলিস্তিন বলতে কোনো ভূমি থাকবে না এবং এরপর তিনি পশ্চিম তীরে অভিযানের দিকে তার মনোযোগ নিবদ্ধ করবেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে এটাই ধরে নেওয়া যায় যে, আগামী বছরগুলোতে অত্যাচারের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পাবে।
হামাস নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে যে তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে হামাসের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পশ্চিমা তত্ত্ব মোতাবেক গাজায় শান্তি ফিরে আসবে কি না, এটা বুঝতে হলে আমাদের আরব ও মুসলিম দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির দিকে নজর দিতে হবে। ট্রাম্প দাবি করছেন যে, তার এই পরিকল্পনায় তাদের সম্মতি রয়েছে। কিন্তু এর অর্থ তো এটা নয় যে, আরব ও মুসলিম দেশগুলো কেবল ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে সব শর্ত মেনে নেবে, এখানে তাদের নিরাপত্তার স্বার্থও জড়িত রয়েছে। হামাসকে লক্ষ্য করে মাত্র কয়েক দিন আগে ইসরাইল যেভাবে কাতারে হামলা পরিচালনা করল এবং এর একধরনের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করল, এমনটা হয়তো ভবিষ্যতেও অন্য দেশের ক্ষেত্রে চলতে পারে। সেই শঙ্কা থেকেই আরব দেশগুলো সম্প্রতি একটি যৌথ আরব নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টির বিষয়ে আলোচনা করেছে, যা হবে অনেকটা ন্যাটোর আদলে। এই প্রক্রিয়ার পথে তারা কতটা সফল হবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ইসরাইলের প্রতি তাদের বরাবর অবিশ্বাস ভবিষ্যতে হামাস না হলেও অন্যনামে ইসলামপন্থি বিভিন্ন গ্রুপের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতার দিকে উত্সাহিত করতে পারে। তাছাড়া হামাসের উত্পত্তির দিকে নজর দিলে আমরা দেখব যদিও সংগঠনটির সৃষ্টি হয়েছে ১৯৮৭ সালে, এর শেকড় কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডের ভেতর নিহিত, যা ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকেই। সুতরাং আজকের হামাসকে এখানেই শেষ করে দিতে যাওয়ার মার্কিন পরিকল্পনা কতটা সফল হবে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
যে কোনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংকট সমাধানে সামরিক শক্তি কখনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নিয়ে আসতে পারে না। বিবদমান দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য উপেক্ষা করে একপেশে সমাধান আসলে কার্যকরী সমাধানের পরিবর্তে সংঘাতকে অনেক বাড়িয়ে তুলতে পারে। গাজা নিয়ে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু যা ভাবছেন, তা আত্মঘাতী, দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানকে উপেক্ষা করা এই সংকটের কোনো সমাধান হতে পারে না।