সত্য, মানবতা, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, অসাম্প্রদায়িকতা এবং কার্যকরী সংসদ প্রতিষ্ঠা জাতিকে কল্যাণমূলক জাতিতে পরিণত করা হলো জাতি গঠনে কাজ করা এবং তাদেরকে সংঘাত দ্বন্দ্বমুক্ত রাখা সত্য পথে পরিচালিত করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা তার মূল পথ। জাতীয় চরিত্র গঠন করা এবং জাতি গঠনে সবাই এক হয়ে আসা জরুরি। সবার মধ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসা খুবই প্রয়োজন। সত্য সুন্দরের চর্চা করা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা দরকার। মানুষের ভেতর গঠনমূলক কাজ করা এবং গঠনমূলক কাজে সহযোগিতা করা আমাদের সবার কাম্য হওয়া উচিত। মানুষ দুনিয়ায় জন্মগ্রহণ করলেই জীবন সার্থক হয় না, বরং আরো দশজনের কাছে সত্যকে পৌঁছে দেওয়াই সার্থকতা। মানুষকে প্রতিষ্ঠা করতে হয় মানবিক জ্ঞানসম্পন্ন করে। তাদেরকে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে হয়, এক সত্যে উদ্বুদ্ধ করতে হয়। জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হয়।
জাতির ব্যক্তি চরিত্র সংগঠন করতে হয়, যাতে জাতীয় চরিত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। ব্যক্তি চরিত্র প্রতিষ্ঠা না হলে জাতীয় চরিত্র প্রতিষ্ঠা হবে কীভাবে? মানুষ তার মর্যাদা স্রষ্টার পরেই স্থান পেয়েছে, কিন্তু সে যদি হানাহানি এবং কাটাকাটিতে মগ্ন হয়, তাহলে অবস্থা হবে নিকৃষ্ট চতুষ্পদ জানোয়ারেরও নিচে। তখন মানুষের চেহারা নিয়ে বেঁচে থাকাটা বেমানান দেখাবে। মানুষ পেতে পারে না আলোর ঠিকানা। আলো আর আলোকিত এক নয়। একটা প্রদীপ হাজার প্রদীপকে প্রজ্বলিত করতে পারে কিন্তু প্রদীপের আলোর বিন্দুমাত্র ভাটা পড়বে না। আবার তেল যদি ফুরিয়ে যায়, তাহলে প্রদীপ জ্বলতে পারে না। সমাজ হলো প্রদীপের তেল। এই সমাজ যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে প্রদীপ জ্বলতে পারে না। একাধিক প্রদীপের স্থলে একটি প্রদীপও যদি না জ্বলে, তাহলে সমাজ সর্বনাশা অন্ধকারের করালগ্রাসে নিমজ্জিত থাকে। মানব জাতির অন্ধকার মোড়ে মোড়ে আলো জ্বালানোর জন্য স্রষ্টা জ্ঞানের মশাল প্রদান করেছেন। মানুষ যাতে খামাখা রক্তপাত করে ধ্বংস হয়ে না যায়, তার জন্য সত্য ও সুন্দরের শিক্ষা প্রদান করেছেন।

পরমতের প্রতি সহিষ্ণুতা, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, অন্য দলের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ এই গণতান্ত্রিক মানসিকতা আজ বিশ্বব্যাপী খুবই প্রয়োজন। গণতন্ত্র শুধু নির্বাচন নয়। সংসদীয় গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে সম্ভব হলেও গণতান্ত্রিক মানসিকতা অর্জন করা কঠিন। স্রষ্টা জগত্ সৃষ্টি করেই ছেড়ে দেননি। বরং তিনি জ্ঞান প্রদান করেছেন, যাতে সে ধ্বংস না হয়। কারণ মানুষের যেমন আছে সুপ্রবৃত্তি, তেমন আছে কুপ্রবৃত্তি। প্রবৃত্তির তাড়নায় সে যেমন ভালো কাজ করে, আবার প্রবৃত্তির তাড়নায় সে এমন কাজ করে, যা তাকে নিকৃষ্ট চতুষ্পদ জানোয়ারের চেয়ে অধম বানিয়ে দেয়। পশুরও ধর্ম আছে। একটি পশু লাখ লাখ পশুকে হত্যা করেছে এবং লাখ পশুর খাদ্য বিনষ্টের কারণ হয়েছে, এটা দেখা যায় না। অথচ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ এই কাজটি করেছে। সুতরাং মানুষের কুপ্রবৃত্তিকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তার শিক্ষা বাল্যকাল থেকে দিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধ এবং সত্য শিক্ষা দিতে হবে, যার মাধ্যমে সে সুশিক্ষা পেয়ে প্রকৃত মানুষ হতে পারে।
শিক্ষকরা হবেন মানুষ গড়ার কারিগর। একজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত ও সুসম্পন্ন কারিগর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে তারাই হবেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। দেশপ্রেম সৃষ্টি করতে না পারলে জাতির ওপর নেমে আসতে পারে পরাধীনতার শৃঙ্খল, যার মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বাদ থেকে সে বঞ্চিত হয়ে পরের গোলামে পরিণত হতে পারে। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ পাইনি। তবে একটা কথা মেনে নেওয়া জরুরি যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তাই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য জাতিকে দেশপ্রেমিক হতে হবে।
মানুষ পৃথিবীতে শুধু নিজ সুখভোগের জন্য আসেনি। বরং উপযোগবাদী মানসিকতা নিয়েই পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। মানুষ পেয়েছে শান্তির ঠিকানা। কিন্তু আজ বিশ্বব্যাপী সর্বগ্রাসী হিংস্রতা এবং ধ্বংসের খেলা লক্ষ করা যাচ্ছে। বোমার আঘাতে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। মানব জাতির ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তাবিদদের ভাবিয়ে তুলেছে। মানুষের ভাগ্যে কী আছে—ধ্বংস না শান্তি। বিশ্ব আজ অশান্তির দাবানলে দাউ দাউ করে জ্বলছে। এ থেকে মুক্তির উপায় আবিষ্কার করা সম্ভব না হলে যে কোনো জাতির ভবিষ্যৎঅন্ধকার। বিশ্বের মানুষ শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ গড়ে তুলেছিল, কিন্তু জাতিসংঘ সংঘ হতে পারল কোথায়? সুতরাং মানুষের মুক্তি গতানুগতিক শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব নয়। বরং মানুষের ভেতর সত্যের শিক্ষা দিতে হবে, যার মাধ্যমে মানবজাতির মুক্তি সম্ভব। আর মানবজাতি যদি মুক্তি পায়, তাহলে শান্তির জন্য সংগ্রাম করা লাগবে না। বরং শান্তিতে থাকাটাই হবে তার স্বভাব, স্বাভাবিক।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও দর্শনশাস্ত্র শিক্ষক