ফেসবুকে, টুইটার, ইউটিউব, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনের পর্দাসহ যে কোনো প্রচারমাধ্যমের দিকে তাকাই না কেন, মনে হয় যেন আমরা চরম অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা, নির্মমতাসহ নানা ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করছি। ঘুষ, দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, খুন, ছিনতাই, ধর্ষণ, নির্যাতন, মারামারি, হানাহানি এসব যেন আজকাল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সত্যি দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক। এসব বিধিবহির্ভূত অনৈতিক কর্মকাণ্ড বা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার বেড়াজাল থেকে কোনোভাবেই যেন আমরা বেরিয়ে আসতে পারছি না। চারদিকে তাকালে কোনো কিছুরই অভাব চোখে পড়ে না। অভাব অনুভূত হয় শুধু মানবিক মূল্যবোধ ও সহানুভূতির। এক কথায় বলা যায় অভাব চোখে পড়ে শুধু ‘মানবতা’র। কিন্তু যেভাবেই হোক, প্রতিকূলতার এই বেড়াজালকে ছিন্ন করে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবেই হবে।
বিবেক-বুদ্ধি আছে বলেই মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই বিবেক বুদ্ধির মাধ্যমে মানুষ ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারে। ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পেরে পরার্থ রক্ষা করে জীবনযাপন করাকেই বলে মানবতা। মানবতা হচ্ছে মানব চরিত্রের অন্যতম প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্য—যা কোনো ব্যক্তিকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে বিশেষায়িত করে পরিচিতি দান করে। মানবতা মানব চরিত্রের এমন একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য যা কোনো ব্যক্তিকে মানুষের মাঝে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখে, অর্থাত্ মানুষকে অমরত্ব দান করে। ক্ষুধার্তকে অন্ন দান, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দান, পীড়িতকে চিকিৎসা দান—এর সবই মানবতা। তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির তৃষ্ণা নিবারণ করানো, এমনকি পথ ভোলা পথিককে সঠিক পথ দেখিয়ে দেওয়াটাও মানবিক গুণ এবং এগুলো মানবতার বহিঃপ্রকাশ।
পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই যে, ধর্ম মানবতাকে সমর্থন করে না। পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ হয়তো খুঁজে পেতে কষ্ট হবে, যিনি মানবতাকে সমর্থন করেন না। কিন্তু তারপরও মানবতা কেন সোনার হরিণের মতো? মানুষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। মানুষ মানুষের অধিকার হরণ করছে। এর সবকিছুই হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ বা মানবতার অভাবে।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দুর্দমনীয় লোভ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে আমরা অনেকেই নিজের কাছে নিজে হেরে যাই। নিজের মধ্যে থাকা মানবতাকে গলা টিপে হত্যা করে অমানবিক কার্যকলাপে লিপ্ত হই। মানবতাকে ভুলে গিয়ে অমানবিক কর্মকাণ্ডের অতল গহবরে আমরা তলিয়ে যাই। পৃথিবীতে সমস্ত সম্পদ ফেলে রেখে সবাইকে ছেড়ে একদিন শূন্য হাতে চলে যেতে হবে—এমন নির্মম সত্যকে জেনেও সেই সত্যকে আমরা অনেক সময় ভুলে যাই। অর্থের প্রাচুর্য আর সম্পদের পাহাড় গড়ার লোভে জীবন রক্ষাকারী উপাদানগুলোকে জীবন বিধ্বংসী বা প্রাণঘাতী উপাদানে পরিণত করি। আমাদের বিবেক বুদ্ধি চিন্তা চেতনা এবং মানবতা এতটাই নিচে নেমে এসেছে যে, খাদ্যদ্রব্য, ফলমূল, জীবন রক্ষাকারী ওষুধে পর্যন্ত ভেজাল দিতে কিংবা নিম্নমানের নকল পণ্য উৎপাদনে আমরা দ্বিধাবোধ করছি না।
সীমাহীন লোভ ঐ মানুষগুলোকে অমানবিক মানুষে পরিণত করে। তাদের কারণে একদিকে চারপাশে নির্মমতা ছড়ায় অন্যদিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় মানবতা। কিন্তু না, আসুন সব ধরনের অমানবিক কর্মকাণ্ডকে আমরা ‘না’ বলি। সব ধরনের অমানবিক চিন্তা চেতনা এবং অমানবিক কর্মকাণ্ডের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে প্রাণপণে চেষ্টা করি। আমাদের অর্জিত সম্পদে অন্যদের যে হক বা অধিকার রয়েছে, এই অনুভূতিটুকু নিজেদের মধ্যে জাগিয়ে তুলি এবং চারপাশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেই। যুদ্ধ বিগ্রহ, অশান্তি, অস্থিরতা আমাদের কাম্য নয়। আমরা ন্যায়-নীতি, শান্তি ও মানবতার পক্ষে। আসুন মানবতাকে সবাই সমস্বরে বলি ‘হ্যাঁ’।
আসুন মানবতার পতাকাতলে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই এই মর্মে যে, কোনো মানুষকে আমরা নিরন্ন রাখব না। আমরা কোনো মানুষকে বিবস্ত্র থাকতে দেব না। কোনো মানুষকে আমরা বিনা চিকিৎসায় মরতে দেব না। আমরা কোনো মানুষের করুণ আর্তনাদ শুনতে চাই না। মানবতাকে আমরা জগত্ময় ছড়িয়ে দেব। মানবতার উজ্জ্বল আলোয় সমস্ত জগতকে আমরা আলোকিত করব। তাহলেই আমাদের ‘মানুষ’ বলে ডাকা সার্থক হবে।