শুক্রবার। ভোর ৫টা, শ্যামলীর নিস্তব্ধ গলি। হিমেল হাওয়া বইছে, আর তার সঙ্গে মিশে আছে এক নতুন শিল্পের পূর্বাভাস—ছিনতাই শিল্প! এতদিন আমরা জানতাম ছিনতাই মানে টাকা-পয়সা, মোবাইল, গহনা, বড়জোর হাতঘড়িটা। কিন্তু ওসব তো ছিল গত শতাব্দীর সেকেলে ধারণা। বর্তমানের অত্যাধুনিক ছিনতাই শিল্পে, বিশেষ করে শ্যামলী ব্রাঞ্চে, এখন নতুন সংযোজন হয়েছে—পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জুতা!
আমাদের শিমিয়ন ত্রিপুরা মশাই, ধামরাইয়ের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিবেদিতপ্রাণ কর্মচারী, ভাগ্যচক্রে এই নবধারার শিল্পের প্রথম দিকের দর্শক (এবং ভুক্তভোগী) হয়েছেন। ভোর ছটায় সাভারের বাসে চড়ার তাড়া ছিল, কিন্তু ভোরের আলো ফোটার আগেই তিন মূর্তিমান যমদূতের মতো আবির্ভূত হলো এক মোটরসাইকেলে চড়ে। হাতে চাপাতি! ভাবুন একবার, কী ক্রিয়েটিভ আইডিয়া! ভোরের আলো ফোটার আগেই মানুষ যখন ঘুম জড়ানো চোখে রাস্তায় নামে, তখন তাদের সব মূল্যবান সামগ্রী (এবং এখন পোশাকও) ছিনিয়ে নেওয়ার এই পরিকল্পনা কি কোনো সাধারণ মস্তিষ্ক থেকে আসতে পারে?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায় এক হূদয়বিদারক দৃশ্য। টাকা-পয়সা, মোবাইল, ক্রেডিট কার্ড—এগুলো তো গেলই, কিন্তু এরপর যখন শিমিয়ন বাবুর গায়ের জামা আর পায়ের জুতাও খুলে নেওয়া হলো, তখন সত্যি বলতে কি, ছিনতাইয়ের সংজ্ঞাটাই পালটে গেল। মনে হচ্ছিল, নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠার এক মহত্ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলেন। এটা শুধু ছিনতাই নয়, এটা একরকম নতুন ফ্যাশন স্টেটমেন্ট! হয়তো শীঘ্রই ফ্যাশন র্যাম্পের মডেলরা চাপাতি হাতে, লুণ্ঠিত পোশাকে হেঁটে দেখাবে নতুন ট্রেন্ড!
এখন প্রশ্ন হলো, এরপর কী? অন্তর্বাস? ভাবুন একবার, শিমিয়ন ত্রিপুরা এক প্যান্ট আর গেঞ্জি নিয়ে কোনোমতে মানসম্মান বাঁচিয়েছেন, কিন্তু ভবিষ্যতে যদি অন্তর্বাসও খুলে নিয়ে যায়, তাহলে তো ইজ্জত বাঁচানো দায় হবে! হয়তো তখন ছিনতাইকারীরা বলবে, ‘ভাই, এই আন্ডারওয়্যারটা আমার নতুন কালেকশনের সঙ্গে মানাচ্ছে না, তাই নিলাম। পরের বার আপনাকে ব্র্যান্ড নিউ অন্তর্বাস দেখাব!’
দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে পুলিশের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে লাভ নেই। এখন রাজধানীবাসী বরং ‘ইজ্জত বাঁচানোর জন্য অন্তর্বাসের গ্যারান্টি’ চায়। একসময় বলা হতো, ‘ইজ্জতের জন্য জীবন দাও’। এখন বলতে শুরু করেছে, ‘জীবন রইল, ইজ্জতটুকু বাঁচাও।’
সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ছিনতাই নিয়ন্ত্রণের আশা করাটা যেন এক অলীক রূপকথা—যেখানে রাজপুত্র আসবে ঘোড়ায় চড়ে, পুলিশের পোশাক পরে, আর ছিনতাইকারীকে ধরে নিয়ে যাবে কোনো এক জাদুর ভ্যানে। বাস্তবে রাজপুত্র আসে না, আসে তিন জন লোক, চাপাতি হাতে। আর পুলিশ আসে ঘটনার ছয় ঘণ্টা পর, ফাইল হাতে, বিরক্ত বদনে। তাই এখন সময় এসেছে—ছিনতাই প্রতিরোধে নাগরিক উদ্ভাবন চালু করার। নিচে কিছু যুগান্তকারী কৌশল দেওয়া হলো, যা বাস্তবায়ন করলে আপনি অন্তত জামা পরে বাসায় ফিরতে পারবেন :
দিগম্বর পলিসি—‘যার কিছু নেই, তার ভয় কী!’ :
বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কিছুই নিয়ে যাবেন না। না মানিব্যাগ, না মোবাইল, না জামা! শুধুই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বের হন। ছিনতাইকারী দেখে বলবে, ‘ভাই, এই লোক তো নিজের সম্মানই বাসায় ফেলে এসেছে, আমরা কিই-বা নেব!’ এই কৌশল যদিও সামাজিকভাবে অল্প বিব্রতকর, কিন্তু শতভাগ ছিনতাই প্রতিরোধক। ইজ্জত গেলেও ইনিশিয়েটিভটা আপনার।
মালটি-লেয়ার পোশাক পরিধান—‘পেঁয়াজ ফর্মুলা’:
শীত-গ্রীষ্ম সব সময় তিন-চার স্তরের জামা পরুন। প্রথম স্তর নেবে ওরা, দ্বিতীয় স্তরে হাঁফাবে, তৃতীয় স্তর খুলতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে থাকবে রাস্তায়। আপনি তখন চতুর্থ স্তর পরিহিত অবস্থায় হেসে হেসে অফিসে প্রবেশ করবেন। সতর্কতা :জ্যামে হাঁটলে আপনি ঘেমে রসুনের মতো গন্ধ ছড়াতে পারেন, কিন্তু কমপক্ষে জামাটা থাকবে!
ফ্লিপ-ফ্লপ স্ট্র্যাটেজি—‘স্টাইল নয়, স্ট্রাগলই সঙ্গী’:
পায়ে পরুন ফাটা স্যান্ডেল, পরনে পকেটছেঁড়া পাঞ্জাবি, হাতে পুরোনো ব্যাগ—এই লুক আপনাকে পরিণত করবে এক ‘অলাভজনক টার্গেট’-এ। ছিনতাইকারী দেখেই বলবে, ‘ভাই, এজন্যই তো ছিনতাই করছি… এর অবস্থা দেখি আমাদের চেয়েও খারাপ!’ আর আপনি মুচকি হেসে বলবেন, ‘ধন্যবাদ ভাই।’
পুরোনো মোবাইল ফোন কৌশল—‘নোকিয়ার প্রতিশোধ’:
আপনার স্মার্টফোন বাসায় রেখে দিন, সঙ্গে রাখুন একটি নোকিয়া ৩৩১০। ওরা নিলে হয়তো ফিরেও এসে বলবে, ‘ভাই, এইটা তো চার্জ দিতেই লাগে ১২ ঘণ্টা… আমরা ভুলে গেছি কীভাবে চালায়!’ প্লাস পয়েন্ট : ফোন দিয়ে নিজের আত্মরক্ষা করতে পারবেন, কারণ ৩৩১০ ছুড়লে এক ব্যাটারিতেই ছিনতাইকারী নিস্তব্ধ।
বডি পেইন্টিং—‘ফ্যাশনের নতুন ফরম’:
যেহেতু জামা নিয়ে যাচ্ছে, তাই তার বিকল্প হলো—উল্কি আঁকা পোশাক। শরীরে পেইন্ট করে শার্ট-প্যান্ট আঁকুন। ছিনতাইকারী কিছুই পাবে না, আর আপনি পাবেন ইনস্টাগ্রামে ফলোয়ার! ওরা বলবে, ‘এই লোক তো আর্ট এক্সিবিশনে যাচ্ছে! এখানে কিছু নিলে আমাদেরও ক্যানভাস হতে হবে!’
ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন—‘সম্পর্ক থাকলেই সব মাফ’:
যখন দেখবেন মোটরসাইকেল থেমেছে, চাপাতি বেরিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে বলুন, ‘ভাই, আজ আমার জন্মদিন। একটা গিফট তো দিলেন না।’ সত্যিকারের ছিনতাইকারী একমুহূর্ত থেমে যাবে, হয়তো নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যাবে। ভাগ্য ভালো হলে আপনাকে একটা পুরোনো প্যান্ট দিয়ে বলবে, ‘এইটা রাখো, আমরা তো শুধু মোবাইল নিই, মন তো আর নিই না ভাই!’
ছিনতাই প্রতিরোধক ফ্যাশন—‘বস্ত্র যার, আত্মসম্মান তার!’:
এমন জামা-জুতা পরুন, যেগুলো এতটাই অস্বস্তিকর বা হাস্যকর যে, ছিনতাইকারীরা নিজেরাই চিন্তায় পড়ে যাবে। ‘এইটা যদি আমি নিই, বাসায় নিয়ে গেলে আমার বউই পিটাবে!’ খরচ কম, লাভ বেশি। জামা থেকে না হলেও আত্মরক্ষার হাসির সুযোগ পাবেন।
যেখানে ছিনতাই বেড়ে যায়, সেখানে নাগরিক উদ্ভাবনই শেষ আশ্রয়। আমরা যদি এসব কৌশল আয়ত্ত করি, তাহলে ছিনতাইকারীরাও আমাদের দেখে চিন্তায় পড়বে—‘আজকে ছিনতাই নয় ভাই, আজকে ছুটি।’
সত্যি বলতে কি, ছিনতাইয়ের এই নতুন সংস্করণ একটি বার্তা দিচ্ছে—এই শিল্প এখন কেবল বস্তুগত জিনিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার পর্যায়ে পৌঁছেছে। ভবিষ্যতে হয়তো আপনার চিন্তাভাবনাও ছিনতাই হয়ে যাবে! তখন দেখবেন, সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবছেন, ‘আরে, আজ কি আমি শিমিয়ন ত্রিপুরা?’ এই যখন পরিস্থিতি, তখন আর কী করার! ইজ্জত বাঁচানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। হয়তো একদিন ছিনতাইকারীরা শুধু পোশাকই নেবে না, আপনার নাম, পরিচয়, এমনকি আপনার অস্তিত্বও ছিনতাই করে নেবে। সেদিন হয়তো দেখা যাবে, আপনি নিজেই ভাবছেন, ‘আমি কে? আর এই পোশাকবিহীন শরীর নিয়ে আমি কোথায় যাচ্ছি?’
এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশে ‘ছিনতাই ফ্যাশন গাইডলাইন’ চালু করার। যেখানে বলা থাকবে, কোন জামা আপনি পরতে পারেন, যাতে সেটা ‘লাভজনক ছিনতাই বস্তু’ না হয়। হুডির ভেতরে কিছু লুকানোর চেষ্টা করবেন না, ছিনতাইকারী এখন এক্সরে চোখও অর্জন করেছে বলে ধারণা। পুলিশ কী করছে, জানতে চাওয়া হলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ‘আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি’—এই বাক্যটি স্বাধীনতার পর থেকেই তদন্তাধীন রয়েছে।
অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমন হবে—মানুষ ছিনতাইকারীর সামনে জামাকাপড় খুলে আত্মসমর্পণ করবে, যেন তাকে ছুঁয়ে না যেতে হয়। আর ছিনতাইকারী বলবে, ‘ভাই, তুমি আগেই খুলে দিলে, মজা নষ্ট করে দিলে!’ এখন আমাদের দেশে ছিনতাই প্রতিরোধ নয়, বরং ছিনতাই-সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপনের কৌশল শেখার সময় এসেছে। একটা নতুন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে যারা জন্মের পরই হয়তো ‘ছিনতাই সহনশীলতা ট্রেনিং’ নেবে, যাতে অন্তত জামাটা শেষ মুহূর্তে বাঁচাতে পারে। পরিশেষে, একটাই কথা—যদি আপনি ছিনতাইয়ের শিকার হন, নিজেকে দোষারোপ করবেন না। আপনার মোবাইল, টাকা, জামা, জুতা যাক, অন্তত আত্মসম্মান বাঁচিয়ে একটা সেলফি তুলুন। ক্যাপশন দিন :‘ভোর ৫টায় পোশাক হারালাম, কিন্তু স্টাইল রইল!’
শ্যামলীর সেই গলিটি এখন কেবল একটি রাস্তা নয়—এটি আমাদের লজ্জার যাত্রাপথ। আর শিমিয়ন ত্রিপুরা, আপনি শুধু ছিনতাইয়ের শিকার নন, আপনি আমাদের সময়ের নীরব প্রতীক। আমরা শুধু আশা করি, পরের বার অন্তর্বাসটা যেন রয়ে যায়।
‘পোশাক গেল, এখন শুধু আত্মা হাতে নিয়ে হেঁটে চলি রাজধানীর পথে…’
লেখক : রম্যরচয়িতা
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না।)