ধর্ষণই হয়নি, কিন্তু ধর্ষণের বিচার চেয়ে হরতাল, বিক্ষোভ, আগুন, নিন্দা, প্রতিবাদ কিছুই বাদ যায়নি। দেশের বিশিষ্টজনদের উদ্বেগ-বিবৃতি। সাধারণ মানুষ হতচকিত। নানা জিজ্ঞাসা। এর মধ্য দিয়ে তিন জনের প্রাণহানিসহ হতাহত বেশ কয়েক জন। মহলবিশেষের জরুরি ছিল উত্তেজনা তৈরি করা। এখন ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হওয়ায় তাদের কিছু যায়-আসে না। কিছুদিন একটু দম নেবে। কয়েক দিন পর আবার আরেকটা ছুতায় নামবে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। হাইপ তুলবে। ঘটনা ঘটবে। হয়ে আসছে এভাবেই।
তাদের মূল টার্গেট সেনাবাহিনী। কারণ সেনাবাহিনী তাদের জন্য খুব ডিস্টার্ব। সেনাবাহিনী পার্বত্যাঞ্চলে থাকায় তারা যথেচ্ছা চাঁদাবাজি করতে পারে না। দিতে পারে না অস্ত্রের মহড়া। জুম ল্যান্ড বাস্তবায়ন এগোয় না। খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীর মেডিক্যাল রিপোর্টে যে ধর্ষণের আলামত মেলেনি, কিন্তু এমন একটা গুরুতর অভিযোগ এনে কয়েকটা দিন পার্বত্যাঞ্চল তামা তামা করে দেওয়ার চেষ্টা চলল— এর কী বিহিত হবে? চলবে এভাবেই? ঘটনাস্থল ও তারিখ ফাঁকা রেখে বিবৃতি-নিন্দার ড্রাফট করে রাখতে হবে? দেশের বাকি ৬১টি জেলার সঙ্গে পার্বত্য তিন জেলার ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক অমিল অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। সংস্কৃতি, ধর্ম, বর্ণের বাস্তবতা মাথায় রাখতেই হবে। হঠাৎ পার্বত্য জেলাগুলোকে অশান্ত করার ক্রিয়াকর্মও নজরে রাখতে হবে। তথ্যগত ঘাটতি কিন্তু হচ্ছে না। এবারও কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, সেই তথ্য জানার বাইরে নয়। সেনাবাহিনীসহ গোয়েন্দাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে।

কেউ পাহাড়ের অধিকার আন্দোলনকে পেছন দিকে নিয়ে যায়। কেউ চায় নতুন রূপ দিতে। আরো পক্ষ যোগ করতে। মাঝে দিয়ে মরে, মারে পাহাড়ি বা বাঙালি। পাকিস্তান জমানায় নানা ঘটনার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী চাকমা রাজনীতিবিদ স্বায়ত্তশাসন এবং ঐ অঞ্চলের জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দাবি উত্থাপন করেন। লারমা ও অন্যান্য পার্বত্য আদিবাসীর প্রতিনিধিরা খসড়ার বিপক্ষে অবস্থান নেন। তাদের মতে, ঐ সংবিধানে নৃ-জাতিগোষ্ঠীকে স্বীকৃতিসহ অমুসলিম ও অবাঙালিদের সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে লারমার নেতৃত্বে নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, ১৯৯৭ বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি নামের চুক্তিটি আসলে বাস্তবায়ন হয়নি। পাহাড়ি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর দীর্ঘদিনের দাবি, সেনাক্যাম্প সরানোর।

সাম্প্রতিক এ ঘটনাকেও নিয়েছে যুতসই অজুহাত হিসেবে। অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভুল বার্তা পাঠানো এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে দুর্বল করার নতুন একটি ঘটনার অপেক্ষায় ছিল এই চক্র। ঘটনার চক্র বা কাকতালীয়ভাবে গত বছরও সেপ্টেম্বরকেই বাছাই করেছিল তারা। ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেলচালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলো দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা করে। জড়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে। ঐ ঘটনার এক বছর পূর্তির মতো এ বছরও খাগড়াছড়িতে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর চেষ্টা।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণের অভিযোগকে আমলে নিয়ে ইউপিডিএফের দাবি করা সন্দেহভাজন শয়ন শীলকে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ২৪ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয়। নেওয়া হয় পুলিশ হেফাজতে। ঘটনাটির সত্যতা বিচারে আইনি প্রক্রিয়া চলমান। শয়ন শীলকে গ্রেফতার করা সত্ত্বেও ইউপিডিএফের অঙ্গসংগঠন পিসিপির নেতা উখ্যানু মারমা ‘জুম্ম ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে গত ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল এবং প্রতিবাদী মানববন্ধনের ডাক দেন।

এর ধারাবাহিকতায় ২৫ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফের আহ্বানে খাগড়াছড়িতে অর্ধবেলা হরতাল পালন করা হয়। একই সময় দেশ-বিদেশে অবস্থানরত ব্লগার এবং পার্বত্যাঞ্চলের কিছু ব্যক্তি অনলাইনে বাঙালিদের উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন রকম অপপ্রচার ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করে। পরিকল্পনা মতো, ২৬ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ কর্মী উখ্যানু মারমার নেতৃত্বে এবং সামাজিক মাধ্যমে দেশি ও প্রবাসী ব্লগারসহ পার্বত্য জেলার কিছু ব্যক্তির উসকানিমূলক প্রচারণা। এর জেরে গোটা খাগড়াছড়িতে উত্তেজনা। অবরোধ চলাকালে একপর্যায়ে ইউপিডিএফের প্ররোচনায় উচ্ছৃঙ্খল এলাকাবাসী টহলরত সেনা দলের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। বাজার, দোকানপাটে আগুন দেয়।
এমন উসকানির মধ্যেও সেনাবাহিনী ধৈর্য, সংযম ও মানবিকতার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলপ্রয়োগে যায়নি। ২৭ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিসহ সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালায়। ভাঙচুর, অ্যাম্বুল্যান্সে আক্রমণ, রাস্তা অবরোধসহ নাশকতাও বাদ দেয়নি। খাগড়াছড়ি পৌরসভা এলাকার আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটাতে তারা সক্ষম হয়। দিনদুপুরে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। অবস্থা বিবেচনায় জেলা প্রশাসন খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। এর পরও হাল ছাড়ছে না মতলববাজরা।
গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামকেই অস্থিতিশীল করার সুপরিকল্পিত ছকে এগোচ্ছে তারা। এলাকার নারী ও স্কুলগামী কোমলমতি শিশুদের বিভিন্ন পন্থায় তাদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে টেনে আনছে। বহিরাগত সন্ত্রাসীদেরও জড়ো করেছে। পার্বত্য জনপদকে অশান্ত করতে নতুন করে তাদের একটা মরণকামড় স্পষ্ট। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার একটা বিরাট অংশের সীমানা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে। কক্সবাজার জুড়ে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের বিচরণ।
বাংলাদেশের রাজনীতি-কূটনীতি, বিশেষ করে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে এগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আর স্থানিকভাবে পার্বত্য ভূমির মালিকানাবিষয়ক জটিলতার নিষ্পত্তি জরুরি। পাহাড়ে অশান্তি পাকাতে এ নিয়ে বিরোধ, পাহাড়ি-বাঙালি অবিশ্বাসকে পুঁজি করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে গঠিত কমিশনের কোনো আপডেট তথ্য নেই। অন্তর্বর্তী সরকার এ কাজটির মাধ্যমে ইতিহাস গড়তে পারে।
লেখক : সাংবাদিক।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)