কৃষিই উন্নয়নের ভিত্তিমূল। আর অঞ্চলভিত্তিক সুষম উন্নয়ন দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে বেগবান করে। দেশে কৃষির বেশকিছু বিশেষায়িত অঞ্চল রয়েছে, যেমন—উপকূলীয় অঞ্চল, হাওর অঞ্চল, বরেন্দ্র অঞ্চল, পাহাড়ি অঞ্চল, নগর অঞ্চল ইত্যাদি। এছাড়াও কৃষি-পরিবেশ অঞ্চল (এইজেড) রয়েছে ৩০টি। সে সুবাদে দেশের কৃষি বেশ বৈচিত্র্যময়। একেক এলাকা একেক ফসলে আধিপত্য বিস্তার করে। অঞ্চলভিত্তিক মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও সংস্কৃতি ভিন্নতর। এই খাদ্যাভ্যাসের ওপর ভিত্তি করে কৃষির চাহিদা যেমন বাড়ে এবং উৎপাদন পরিকল্পনাও সে অনুযায়ী দরকার।

এছাড়া কৃষিজপণ্যের বহুমুখী ব্যবহারেরও গুরুত্ব রয়েছে। আবার কোনো কোনো এলাকায় কৃষিজ উৎপাদনের প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ আছে। যেমন—কোনো কোনো এলাকায় টম্যাটোর দাম না পাওয়ায় খেত থেকেও টম্যাটো উঠাচ্ছে না, আবার অন্য জায়গায় টম্যাটোর দাম না পেলেও সে টম্যাটো থেকে টম্যাটো সস ও টম্যাটো কেচাপ বানিয়ে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন। এটি কৃষির বহুমুখীকরণের সুফল বলা যায়। অর্থাৎ, কৃষির ভর মৌসুমে পণ্যের দাম পাওয়া না গেলে সেক্ষেত্রে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের সুযোগ তৈরি করে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য তৈরি করা গেলে কৃষক লাভবান হবেন। একই কৃষিপণ্যকে নিয়ে বহুবিধ পরিকল্পনা তৈরির সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলে কিছু কিছু ফসল বেশ জনপ্রিয়। এসব অঞ্চলভিত্তিক জনপ্রিয় দুই একটি ফসলকে টার্গেট করে কম্প্রিহেনসিভ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা গেলে সুফল মিলবে বেশ।
একেক অঞ্চলের কৃষক একেক বিষয়ে দক্ষ। যেমন একই কৃষিপণ্য থেকে বহুরকম ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য তৈরির সুযোগ রয়েছে। নর্থ বেঙ্গলে যেভাবে খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি হয়, সেটিকে শিল্প হিসাবে ঘোষণা করলে এটির মান ও বিশ্বস্ততা বাড়ত। উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ বাড়ত। একইভাবে পাহাড়ি এলাকাসহ যেসব এলাকায় ইক্ষু আবাদ হয় বেশি, সেখানে ইক্ষুর গুড় তৈরির ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা প্রদান করা গেলে এটিও এলাকাভিত্তিক শিল্প হিসাবে গড়ে উঠত। অনেক এলাকায় তিলের আবাদ হয় খুব বেশি। সেসব এলাকার তিল থেকে হরেকরকম ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য তৈরি করে বাজারজাতকরণের সুযোগ বৃদ্ধি করা গেলে উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। সেক্ষেত্রে পরিকল্পনামাফিক বিদেশে রপ্তানির বাজার অনুসন্ধান জরুরি। অঞ্চলভিত্তিক কৃষির রূপান্তর ঘটাতে হলে অঞ্চলভিত্তিক কৃষির স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। প্রতিটি অঞ্চলের কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নিয়ে একটি সমন্বিত টেকসই কৃষি পরিকল্পনা করা গেলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। এর জন্য দরকার এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা নিরূপণ ও প্রায়োরিটি সেটিং এবং এর বাস্তব প্রয়োগ। সেজন্য প্রায়োগিক গবেষণার ওপর বেশি জোর দেওয়া দরকার।
দেশে কৃষির ছয়টি হটস্পট রয়েছে, যেমন—উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল, নদী ও মোহনা অঞ্চল, নগর অঞ্চল ও ক্রসকাটিং অঞ্চল (শেরপুর, নীলফামারী ও গাজীপুর জেলা)। এসব হটস্পটের পানিসম্পদ, ভূমি, কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, খাদ্যনিরাপত্তা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভূ-প্রতিবেশ, নদীর অভ্যন্তরীণ ব্যবহার, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা, পলি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, কৃষিতে পানির চাহিদা নিরূপণ ও সুপেয় পানি সরবরাহের বিষয়সমূহ জড়িত রয়েছে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক কৃষির মাস্টারপ্ল্যান তৈরি সময়ের দাবি। হটস্পটভিত্তিক কৃষিপরিকল্পনা ও এর সঠিক বাস্তবায়নের জন্য যা দরকার, তা হলো—সেক্টর অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক অগ্রাধিকার নির্ধারণ ; সমস্যা চিহ্নিতকরণ; চাহিদা নিরূপণ; স্ট্যাক-হোল্ডার নির্বাচন, সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ; মালটিপারপাস পার্টনারশিপ (এমএসপি) প্ল্যাটফরম গঠন, বাজার অনুসন্ধান; বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন; কৃষিপণ্যের ভ্যালু অ্যাডিশনের সুযোগ তৈরি, প্রক্রিয়াজাতকরণের সুযোগ বাড়ানো; সংরক্ষণাগার স্থাপন, পণ্য সংগ্রহোত্তর কালেকশন সেন্টার ও হটস্পটভিত্তিক বাণিজ্যিক এলাকায় প্যাক-হাউজ নির্মাণ; কৃষক সংগঠন শক্তিশালীকরণ; বাজারকমিটি পুনর্গঠন ও সরবরাহ চেইন সংক্ষিপ্তকরণ ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
এলাকাভিত্তিক কৃষকদের উৎপাদন পরিকল্পনায় দক্ষ করে তোলার পাশাপাশি বিজনেস পরিকল্পনা তথা বাজারজাতকরণে দক্ষ করে তোলা দরকার। সেই সঙ্গে সরবরাহ চেইন সংক্ষিপ্তকরণ ও বাজারের অবকাঠামোর আধুনিকায়ন জরুরি। আঞ্চলিক কৃষি পরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নে গবেষণা ও উদ্ভাবনের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেশে আটটি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। একেকটি আঞ্চলিক কার্যালয় বেশকিছু কৃষি-পরিবেশ অঞ্চলকে (এইজেড) প্রতিনিধিত্ব করে। আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহকে শক্তিশালীকরনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন কৃষি-পরিবেশ অঞ্চল উপযোগী গবেষণার সুযোগ রয়েছে। কৃষিপণ্য বিপণন সমস্যা নিরসনে অঞ্চলভিত্তিক সংরক্ষণাগার ও প্যাক-হাউজ নির্মাণ করে পণ্যের ভ্যালু অ্যাডিশন সুবিধা বাড়িয়ে কৃষিকে লাভজনক করা যেতে পারে।
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে অবকাঠামো উন্নয়নসহ অঞ্চলভিত্তিক কৃষি উন্নয়নে সমভাবে জোর দেওয়া প্রয়োজন। অঞ্চলভিত্তিক জনপ্রিয় ফসলগুলোকে জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেলে রপ্তানির সুযোগ বাড়বে। অঞ্চলভিত্তিক রপ্তানি উপযোগী পণ্য উত্পাদনে উত্তম কৃষিচর্চা এর বাস্তব প্রয়োগসহ কনট্রাক ফামিংয়ে জোর দিতে হবে। কৃষক সংগঠনকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধিসহ মার্কেট লিংকেজ বৃদ্ধি করা দরকার। বিপণন বিষয়ে গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়নে বেশি মনোনিবেশ দরকার। কৃষিসংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে একই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে অঞ্চলভিত্তিক কৃষির মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে মালটি-স্ট্যাকহোল্ডার পার্টনারশিপ বা প্ল্যাটফরম গঠন করার মধ্য দিয়ে অঞ্চলভিত্তিক কৃষির টেকসই ও সুষম উন্নয়ন সম্ভব।
লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বারি। সাবেক ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট, এফএও-জাতিসংঘ