ডেঙ্গু জ্বর মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায় এবং মশা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য হলেও, টিকাদান অতিরিক্ত সুরক্ষা প্রদান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ডেঙ্গুকে শীর্ষ ১০টি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে একটি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছে, যেখানে ২০০০ সালে ৫ লাখ থেকে দশ গুণ বেড়ে ২০১৯ সালে পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অভূতপূর্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথম বারের মতো বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ৬.৫ মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে এবং ৬ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি মৃত্যু হয়েছে। আফ্রিকা, আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ৮০টিরও বেশি দেশে এই রোগে আক্রান্তের ঘটনা রিপোর্ট করা হয়েছে। ২০২৩ সালে এশিয়ায় সর্বোচ্চ মৃত্যুর হার রেকর্ড করা হয়েছে। সেই বছর বাংলাদেশে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, যেখানে ৩,২১,১৭৯টি নিশ্চিত আক্রান্ত কেসের মধ্যে ১,৭০৫ জন মারা গেছে এবং ভয়ংকরভাবে কেস ফ্যাটালিটি রেট বা সিএফআর ০.৫৩ শতাংশ।
এছাড়া, ২০২২ সালে ডেঙ্গুর ধরনে স্থানিক ও সাময়িক পরিবর্তন লক্ষ করা যায় এবং ২০২৩ সালেও তা অব্যাহত থাকে। নেপাল ও বাংলাদেশে স্বাভাবিকের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়ে যায়। ২০২২ সালে নেপালের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কাঠমুন্ডু উপত্যকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব তরাই অঞ্চল এবং ২০২৩ সালে গন্ডাকি প্রদেশের পার্বত্য জেলায় স্থানান্তরিত হয়। ২০২৩ সালে ভারত, কেরালা ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে আক্রান্তের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভিয়েতনামে প্রায় প্রতি ১০ বছরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ দেখা গেছে। তবে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২০১৯ এবং ২০২২ সালে দুটি মহামারি শীর্ষে পৌঁছেছে। ২০২২ সালে, ভিয়েতনামে ৩ লাখ ৬৭ হাজারেরও বেশি ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে, যা বিশ্বব্যাপী ব্রাজিলের পরই দ্বিতীয়। WHO অনুমান করে যে, বিশ্বব্যাপী বার্ষিক প্রায় ৩৯০ মিলিয়ন ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে, যার মধ্যে ৯৬ মিলিয়ন লক্ষণীয় আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখ জন হাসপাতালে ভর্তি এবং ৪০ হাজার জনের মৃত্যু ঘটে।
ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে বাহকের নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নিজদের সুরক্ষায় ভ্যাক্সিনের। এর মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, সুরক্ষিত হবে দেশ। নিরাপদে ভ্রমণ ও জীবনযাপনের জন্য টিকাদানের সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার ব্যবস্থাপনাও তাই অপরিহার্য।
যে কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে, তবে শিশু, গর্ভবতী মহিলা এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগ বা স্থূলকায় ব্যক্তিদেরই আক্রান্তের ব্যক্তিঝুঁকি বেশি। চিকিৎসা না করা হলে ডেঙ্গু হাইপোটেনশন, হার্ট ফেইলিওর, কিডনি ফেইলিওর, হেমোরেজিক শক, মাল্টিপল অর্গান ফেইলিওর, সেরিব্রাল হেমোরেজ এবং কোমাসহ গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। বর্তমানে চিকিৎসা রক্ত পরিস্রাবণ, প্লাজমা বিনিময় এবং শক-বিরোধী ব্যবস্থার মাধ্যমে লক্ষণগুলি পরিচালনার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। গুরুতর রোগীর চিকিৎসার খরচ বেশির ভাগ মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি হতে পারে।
অনুমোদিত ডেঙ্গু ভ্যাকসিনগুলি হল Dengvaxia® এবং Qdenga® (TAK-003), যার কার্যকারিতা এবং সুপারিশকৃত জনসংখ্যা বিভিন্ন। লক্ষণীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধে Dengvaxia®-এর কার্যকারিতা প্রায় ৬০-৮০ শতাংশ, তবে এটি ৯-১৬ বছর বয়সি শিশুদের জন্য সীমাবদ্ধ, যাদের আগে নিশ্চিত ডেঙ্গু সংক্রমণ ছিল। এর কারণ, সেরোনেগেটিভ ব্যক্তিদের মধ্যে গুরুতর রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। অন্যদিকে, Qdenga® উচ্চতর সামগ্রিক কার্যকারিতা প্রদর্শন করে। চার বছর বা তার বেশি বয়সি সেরোপজিটিভ এবং সেরোনেগেটিভ উভয় ধরনের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে লক্ষণগত ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে প্রায় ৮০ শতাংশ সুরক্ষা প্রদান করে।
Qdenga® উদ্ভাবন করেছিল জাপানি কোম্পানি Takeda Pharmaceuticals, যারা চারটি ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ থেকে রক্ষা করার জন্য লাইভ, অ্যাটেনুয়েটেড ডেঙ্গু ভ্যাকসিন (TAK-003) তৈরি করেছিল। Qdenga® অনুমোদনকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে ২০২২ সালে ইউরোপীয় মেডিসিন এজেন্সি (EMA) এবং ইউরোপীয় কমিশন (EC), তারপর ইন্দোনেশিয়া, গ্রেট ব্রিটেন, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো অন্যান্য দেশ।
সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত, QDENGA ৪০টি দেশে অনুমোদিত ছিল এবং ২৭টি দেশে উপলব্ধ, যার মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া (অনুমোদিত আগস্ট ২০২২, উপলব্ধ এপ্রিল ২০২৩), ব্রাজিল (অনুমোদিত মার্চ ২০২৩, উপলব্ধ জুন ২০২৩, থাইল্যান্ড (অনুমোদিত মে ২০২৩, উপলব্ধ আগস্ট ২০২৩), আর্জেন্টিনা (অনুমোদিত এপ্রিল ২০২৩, উপলব্ধ অক্টোবর ২০২৩), (অনুমোদিত ফেব্রুয়ারি ২০২৪), এবং ভিয়েতনামেও উপলব্ধ। এরকম একটি উদ্ভাবন বাংলাদেশে এখনো কেন অনুমোদনের বাইরে তা একটি বড় প্রশ্ন।
Qdenga-এর কার্যকারিতা এবং প্রভাব
Qdenga® টিকা চার ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধেই সুরক্ষা প্রদানে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকারিতা প্রদর্শন করেছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়। এটি বাংলাদেশের মতো বিভিন্ন দেশে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অন্তত একবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। পরবর্তী সংক্রমণ আরো তীব্র হওয়ার প্রবণতা রয়েছে, যার ফলে সময়মতো টিকাদান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হয়ে ওঠে।
ভ্যাকসিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য তাকেদার সঙ্গে যোগাযোগ প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোরালো পরামর্শ অতি প্রয়োজন। মূল উদ্দেশ্য, কীভাবে ডেঙ্গু জ্বরের বার্ষিক বোঝা কমানোর প্রতিশ্রুতিকে জোরদার করা যায়। রক্ষা করা যায় শত শত অমূল্য প্রাণ।
আমাদের দেশের মানুষ ডেঙ্গু-সংক্রামক অঞ্চলে ঘন ঘন ভ্রমণ করে থাকেন। তারা কখন কীভাবে টিকা ব্যবহার করবেন, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। তাদের চাহিদা ও জোগানের মধ্যেও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে সুইডেনের একটি উদাহরণ প্রাসঙ্গিক। সুইডিশ সোসাইটি ফর ইনফেকশাস ডিজিজেস ফিজিশিয়ানসের ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ দল ভ্রমণ ভ্যাকসিন হিসেবে Qdenga® ব্যবহারের নির্দেশনা এবং সুপারিশ দিয়েছে। কী বলেছে তারা?
যেসব ভ্রমণকারীর আগে স্ব-রিপোর্টেড (হাসপাতালে ভর্তি বা পলিক্লিনিক পরীক্ষা) ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে, তাদের জন্য স্থানীয় দেশে ভ্রমণের আগে টিকা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
- ডেঙ্গুতে ভুগছেন এমন ভ্রমণকারীদের ভ্রমণের কাল নির্বিশেষে ৪-১৬ বছর বয়সি ব্যক্তিদের টিকা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।
- ১৭-৬০ বছর বয়সি ভ্রমণকারীদের জন্য শুধু দীর্ঘ ভ্রমণ এবং ভ্রমণের গন্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত টিকা দেওয়ার কথা বিবেচনা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণে ছয় সপ্তাহের বেশি সময় সীমাসমৃদ্ধ টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ সেখানে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ।
- যেহেতু Qdenga® এখনো ৬০ বছরের বেশি বয়সি ব্যক্তিদের ওপর অধ্যয়ন করা হয়নি, তাই তারা স্পষ্টভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন যে, তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত এই জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া থেকে বাইরে রাখা উচিত।
ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোধে বাহকের নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নিজদের সুরক্ষায় ভ্যাক্সিনের। এর মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, সুরক্ষিত হবে দেশ। নিরাপদে ভ্রমণ ও জীবনযাপনের জন্য টিকাদানের সঙ্গে সঙ্গে এডিস মশার ব্যবস্থাপনাও তাই অপরিহার্য।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী, ঢাকা।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)