একটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে তার শিশুর হাসিতে, তাদের নিরাপদ নিশ্বাসে। অথচ আজ আমাদের শহর সেই হাসি কেড়ে নিচ্ছে, শ্বাসরুদ্ধ করছে এক ভয়াল বাস্তবতা। একদিকে উন্নয়নের বুলি, অন্যদিকে মানুষের জীবনের ওপর অমানবিক আঘাত। এই পরস্পরবিরোধী দৃশ্যই আজকের নগরায়নের নগ্নতম চিত্র।
রাজধানীর বহু আবাসিক এলাকায় এখন যেভাবে তেলের কারখানা মাথা তুলছে, তাতে মনে হয়— নিয়ম, আইন, নৈতিকতা সবকিছু যেন হারিয়ে গেছে লোভের কালো ধোঁয়ায়। শিশুরা যেই আকাশের নীল দেখতে চায়, সেখানে এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে কালো ধোঁয়ার গাঢ় চাদর। তাদের নিশ্বাসে মিশে যাচ্ছে মৃত্যুর গন্ধ। প্রতিটি সকাল যেন এক নতুন বিষাক্ত পরীক্ষার দিন, যেখানে বেঁচে থাকাটাই এক চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই সতর্ক করে বলেছেন, এই দূষণ কেবল পরিবেশ নয়, শিশুর ভবিষ্যৎ ধ্বংসেরও হাতছানি। তেলের কারখানা থেকে নির্গত গ্যাস ও ধোঁয়ার মধ্যে যে কার্বন মনোক্সাইড, সালফার, সীসা ও নিকেলের মিশ্রণ থাকে, তা শিশুদের শ্বাসযন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে। ফুসফুসের কোষ ঝলসে যায়, মস্তিষ্কের বিকাশ থমকে পড়ে। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে এই হত্যাযজ্ঞ চললেও আমরা যেন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি এই অস্বাভাবিকতাকেই স্বাভাবিক ভাবতে।
এই অব্যবস্থাপনার শিকড় লুকিয়ে আছে প্রশাসনিক উদাসীনতা ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে। আইন আছে, বিধি আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। আবাসিক এলাকায় কারখানা স্থাপন আইনত নিষিদ্ধ—কিন্তু কে শুনছে? কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী অর্থ আর প্রভাবের জালে জড়িয়ে ফেলেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিবেককেও। ফলে একদিকে কারখানার চিমনি থেকে উঠে আসছে আগুনের ধোঁয়া, অন্যদিকে সমাজের বিবেক থেকে উবে যাচ্ছে মানবতা।
আমরা ভুলে যাচ্ছি—শিশুরা কোনো ‘স্ট্যাটিস্টিক’ নয়, তারা আমাদের আগামী দিনের প্রতিচ্ছবি। তাদের ফুসফুসে জমে থাকা বিষ মানে আসলে জাতির ভবিষ্যৎ নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। এই শিশুরাই একদিন শিক্ষক হবে, চিকিৎসক হবে, নেতৃত্ব দেবে—কিন্তু যদি তারা বেঁচেই না থাকে, তবে কাদের হাতে আমরা আমাদের আগামী তুলে দেব?
প্রশ্ন জাগে, উন্নয়ন কি মানুষের জীবনের বিনিময়ে হতে পারে? যদি উন্নয়ন মানেই হয় শিশুর শ্বাসরোধ, তবে সে উন্নয়ন শাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা চাই শিল্প, কিন্তু সে শিল্প হোক মানবিক; আমরা চাই অগ্রগতি, কিন্তু সে অগ্রগতি হোক জীবনমুখী। তেলের কারখানার অদৃশ্য বিষবাষ্পে যখন একটি শহরের শিশু ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন সেটি আর উন্নয়ন নয়—সেটি এক সভ্য জাতির আত্মবিনাশ।
এই অবস্থায় প্রয়োজন দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপ। সরকারকে অবিলম্বে এসব তেলের কারখানার সুনির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করতে হবে এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে, তাদের কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে শিল্পাঞ্চলে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে আরও জবাবদিহিমূলক করে তুলতে হবে—যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো উদ্যোক্তা জনগণের জীবনের বিনিময়ে ব্যবসা করার দুঃসাহস না পায়।
তবে শুধু সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে দিলে চলবে না। নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। প্রতিটি বাবা-মা, প্রতিটি শিক্ষক, প্রতিটি বিবেকবান নাগরিককে এখন আওয়াজ তুলতে হবে— ‘আমরা আমাদের সন্তানদের বিষ নয়, বাতাস চাই। আমরা কারখানার কালো ধোঁয়া নয়, চাই নীল আকাশ।’ সামাজিক আন্দোলনের শক্তিই পারে এই অন্যায় থামাতে। যদি আমরা নীরব থাকি, তবে আমাদের নীরবতা হবে ভবিষ্যতের প্রতি এক অপরাধ।
ভুলে গেলে চলবে না, শিশুরা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। তাদের রক্ষা মানে আমাদের অস্তিত্বের রক্ষা। আজই যদি আমরা তাদের পাশে না দাঁড়াই, আগামীকাল তারা হয়তো আমাদের কাছ থেকে প্রশ্ন করবে— ‘তোমরা কী করেছিলে, যখন আমরা ধোঁয়ার মধ্যে শ্বাস নিচ্ছিলাম?’ তখন আমাদের নীরবতা হবে সবচেয়ে বড় লজ্জা।
তাই এখনই সময়, আবাসিক এলাকায় অবৈধ তেলের কারখানার বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করার। সময় এসেছে শিশুবান্ধব নগর গড়ার, সময় এসেছে মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোর। আমরা যারা প্রতিদিন এই শহরের কংক্রিটে হাঁটি, তাদের সবার একটাই অঙ্গীকার হোক— এই শহর শিশুর হবে, বিষের নয়। কারণ, শিশুর হাসিই একটি জাতির সবচেয়ে সুন্দর সঙ্গীত।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
(এই লেখা লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত অভিমত; এ সংক্রান্ত কোনো দায় দৈনিক মূলধারা বহন করবে না)