গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করি আমরা। এখানে সবার অধিকার সমান। অন্তত এমনটাই তো আমরা শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে, তাই না? কিন্তু এই অধিকারের সংজ্ঞাটা এখন একটু বদলে গেছে। এখন আর ভোটাধিকার, বাক্স্বাধীনতা বা সমাবেশের অধিকার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। এখন সবচেয়ে বড় অধিকার হলো, ‘অটোপাশ’! হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন, পড়াশোনা না করেই পাশ করার অধিকার। এ যেন এক নতুন নাগরিক আন্দোলন, যেখানে দাবি একটাই—সার্টিফিকেট চাই, কিন্তু বই ছুঁতে রাজি নই।
সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (পাশ) ২০২২ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের একটা অংশ অটোপাশের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য (ভিসি) এ এস এম আমানুল্লাহর ওপর হামলা চালিয়েছে। ঘটনাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপর হামলা এই নতুন ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকারের এক সার্থক প্রতিফলন। শিক্ষার্থীদের একটা অংশ বিশ্বাস করে, পরীক্ষা দেওয়াটা একধরনের মধ্যযুগীয় বর্বরতা। যখন সবকিছু ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, কৃত্রিম মেধা, যন্ত্রমানব সবকিছু দখল করে নিচ্ছে, তখন কি না এখনো কাগজ-কলম আর বই নিয়ে বসে থাকতে হবে? কী হাস্যকর! অটোপাশ বাধ্যতামূলক করা হলে দেশ দ্রুত উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে, কারণ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমে যাবে এবং দেশের মাথাপিছু জিডিপি বাড়বে।
শিক্ষার্থীদের এই বিপ্লবী চেতনার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন জানানো উচিত। কারণ তারা তো গণতন্ত্রের অধিকার চায়—‘অটোপাশ’ হোক বৈধ নাগরিক অধিকার! পরীক্ষা নামক এই পুরোনো প্রথা বাতিল করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি প্রদান করা হোক। এতে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমবে, অন্যদিকে পরীক্ষার খাতা দেখা ও ফলাফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা থেকেও মুক্তি মিলবে। সময় বাঁচবে, বাঁচবে টাকাও! আর শিক্ষকরাও অবসরে বসে চা খেতে পারবেন, কারণ তাদের আর খাতা দেখতে হবে না।
এখন সময় বদলেছে। আগে মানুষ বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করত, এখন মানুষ ফেসবুক স্ক্রল করে মতামত দেয়। আগে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগের রাতে চোখ লাল করে গোটানো খাতার পাতা উল্টাত, এখন তারা ক্যাম্পাসে গিয়ে ‘উপাচার্য হঠাও, অটোপাশ দাও’ ধ্বনি তোলে। শিক্ষা ব্যবস্থার এই গৌরবোজ্জ্বল উত্তরণকে আমরা বলতেই পারি—অটোপাশতন্ত্র।
একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে আমরা যে সময়টায় দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাক্স্বাধীনতা এগুলো কিছুটা সেকেলে হয়ে গেছে। এখন জনপ্রিয় রাজনৈতিক দাবির শীর্ষে আছে—‘সার্টিফিকেট চাই, কিন্তু বইয়ের গন্ধ সহ্য করতে পারি না!’ যে জাতি হজমের জন্য পেপসিডিল খায়, তার কাছে পাশ করার জন্য বই খোলা কি খুব বাস্তবসম্মত?
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক (পাস) কোর্সের একদল বিপ্লবী তরুণ প্রমাণ করে দিলেন, পরীক্ষায় পাশ না করেও সার্টিফিকেট চাওয়াটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়, বরং এটা একধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার, একপ্রকার সাংবিধানিক আবশ্যকতা। তারা ভিসি মহাশয়ের ওপর আঘাত হানলেন ঠিকই, তবে সেটা কোনো দুষ্কর্ম নয়, বরং ছিল ‘নাগরিক অভিমান’-এর প্রতীকী প্রকাশ।
করোনাকালে যে ‘অটোপাশ’ একদা সরকারের উপহারস্বরূপ পাওয়া গিয়েছিল, তা-ই এখন ছাত্রসমাজের কাছে ন্যায্য পাওনা। ওটা একবার দেওয়া হয়েছিল, এখন না দিলেই সংবিধান লঙ্ঘন! ওটা যে একবার পাওয়া গেছে, তার মানে ভবিষ্যতে সেটা পাওয়ার ‘লিগ্যাল লিগেসি’ তৈরি হয়েছে। যেমন, একবার চালু হওয়া সাবসিডি কেউ তুলে নিতে পারে না, তেমনই একবার দেওয়া অটোপাশও আর ফিরিয়ে নেওয়া চলে না।
ভিসি সাহেব বলছেন, ‘কোনো অবস্থাতেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোপাশ দেওয়া হবে না।’ তিনি সম্ভবত ভুলে গেছেন, এটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে অসংখ্য অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সম্মিলিত ইচ্ছাই শেষ কথা। গণতন্ত্রে তো সংখ্যাই মুখ্য—তাই না? এই অবস্থায় পরীক্ষায় ফেল করাটাও একটা মতামত, আর সার্টিফিকেট চাওয়া একটি অধিকারভিত্তিক আন্দোলন। ভিসি সাহেবের উচিত ছিল, এই দাবিকে স্বাগত জানিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে তাত্ক্ষণিকভাবে ‘স্নাতক সম্মাননা’ তুলে দেওয়া।
এই আন্দোলনে বুদ্ধিজীবী সমাজের নিস্পৃহতা সত্যিই হতাশাজনক। কোনো টকশোতে এই সাহসী তরুণদের দাবিকে জাতীয় সংকট হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। অথচ রাজনীতির গন্ধ পেলে অনেকেই তো খাড়া হন! সম্ভবত রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এখানেই নতুন সুযোগ। এনসিপি, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির যদি এখনি ‘অটোপাশ’ ইস্যুতে যুগপত্ কর্মসূচি ঘোষণা করে, তাহলে আগামী নির্বাচনের অর্ধেক ভোটব্যাংক নিশ্চিত!
একটি নতুন রাজনৈতিক দলও গঠিত হতে পারে—‘অটোপাশ পার্টি বাংলাদেশ (এপিপি)’। তাদের মূল ইশতেহার :১. পরীক্ষা নয়, প্রত্যেকেই পাশ ২. খাতা নয়, কেবল পরিচয়পত্রেই ডিগ্রি ৩. ভিসি নয়, ‘চ্যাটজিপিটি’ হোক একাডেমিক সিদ্ধান্তদাতা ৪. পড়াশোনার বদলে ইউটিউব টিউটোরিয়াল দেখে দক্ষতা অর্জন
এই আন্দোলনের সুফল কিন্তু অনেক। যেমন:
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন কমবে।
- খাতা দেখা, নম্বর দেওয়া, ফল প্রকাশ—এই সব ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়ার অবসান হবে।
- ছাত্ররা মুক্ত হবে বইয়ের ভার থেকে, মোবাইলে আরো বেশি সময় কাটাতে পারবে।
- দেশের অর্ধেক বেকার সমস্যা দূর হবে, কারণ সবাই তো ‘সার্টিফিকেটধারী’।
ভাবুন তো, যদি সত্যিই এই অটোপাশ কার্যকর হয়, তাহলে কেমন হবে আমাদের ভবিষ্যত্?
- এক ট্যাব হাতে ডাক্তার, ডায়াগনোসিস ‘গুগলে’
- একঝাঁক ‘ইঞ্জিনিয়ার’ বিল্ডিং বানাচ্ছেন ‘রিলস’ দেখে
- আইনজীবীরা যুক্তির বদলে ব্যবহার করছেন‘মিম’
- আর শিক্ষাবিদরা রচনার বদলে পোস্ট দিচ্ছেন—‘No Exam No Tension’
এমনটা হলে তো দেশ রাতারাতি উন্নত হয়ে যাবে! আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে বলতে পারব, ‘আমরাই বিশ্বের প্রথম দেশ, যেখানে পড়াশোনা ছাড়াই সার্টিফিকেট পাওয়া যায়!’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ওপর হামলা চালানোটা অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু এই হামলার পেছনে যে গভীর দর্শন লুকিয়ে আছে, তা আমরা কজনই-বা বুঝি? এটি নিছকই একটি হামলা নয়, এটি হলো পড়াশোনা না করে সার্টিফিকেট পাওয়ার অধিকার আদায়ের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ! উপাচার্য মহাশয় নাকি ‘কোনো অবস্থাতেই কোনো ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কোনো প্রকার অটোপাশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেবে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ছি ছি! এমন অনুদার মানসিকতা নিয়ে তিনি উপাচার্যের পদে বসে আছেন কী করে? তিনি কি বোঝেন না যে, অটোপাশ হলো এখনকার শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি?
যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হামলাকারীদের চিহ্নিত করে থানায় মামলা দায়েরের উদ্যোগ নিয়েছে। এটাও তাদের একধরনের পুরোনো মানসিকতা। আরে বাবা! হামলাকারীদের ধরতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে, বরং তাদের হাতে সার্টিফিকেট তুলে দিয়ে অটোপাশের এই আন্দোলনকে আরো গতিশীল করে তোলা উচিত। এতে করে অটোপাশ নামক এই নতুন গণতান্ত্রিক অধিকারটি খুব দ্রুতই প্রতিষ্ঠিত হবে।
অটোপাশ চাওয়া এই আন্দোলন শুধু সার্টিফিকেটের জন্য নয়, এটি একটি দার্শনিক বিবর্তন। এটি সেই সমাজের জন্ম দিতে চাইছে যেখানে জ্ঞানের দরকার নেই, প্রয়োজন শুধু ডকুমেন্টেশন। সুতরাং সময় এসেছে স্বীকার করে নেওয়ার—‘আমরা এক গণতান্ত্রিক, উন্নয়নশীল, অটোপাশপ্রবণ রাষ্ট্রে বসবাস করছি।’ এখানে শ্রেণিকক্ষে নয়, সংগ্রামে পাশ হয়। এখানে প্রশ্নপত্র নয়, দাবিদাওয়া মুখ্য।
তাই আসুন, আমরা আর কাঁধে বইয়ের ভার চাপিয়ে প্রজন্মকে ক্লান্ত না করি। শিক্ষার মর্যাদা দিয়ে আর কত দিন চলবে? এখন সময় স্বীকৃতির! এটাই তো একবিংশ শতাব্দীর চেতনা—যেখানে প্রশ্ন কমন না পড়লে আন্দোলন, ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলেও রেজাল্ট চাই, আর লেখাপড়ার নামে যারা এখনো খাটুনি করে, তাদের বলে দেওয়া উচিত—‘থামো, তুমি অতীত!’
আসুন, সবাই মিলে শপথ করি :‘শিক্ষা নয়, স্বীকৃতি চাই! মেধা নয়, মার্কশিট চাই! পড়ি না, তবু পাশ করাই!’
এই হোক আমাদের জাতীয় স্লোগান, এই হোক নতুন যুগের শিক্ষানীতি!
ভবিষ্যতের কোনো এক মন্ত্রী হয়তো একদিন বলবেন, ‘আমি কোনোদিনই পড়ালেখায় ভালো ছিলাম না, কিন্তু আজ আমি শিক্ষা মন্ত্রী!’ কী অনুপ্রেরণা! কী প্রগতিশীল চিন্তা!
তাই সময় এসেছে ‘জ্ঞানতন্ত্র’কে বিদায় জানিয়ে বরণ করে নেওয়ার’—অটোপাশতন্ত্র জিন্দাবাদ!’
কারণ, এই শতাব্দীতে গণতন্ত্র মানে সার্টিফিকেট ফর অল, বই ফর নান!
লেখক : রম্যরচয়িতা